২১ ডিসেম্বর শুক্রবার। বাংলাদেশ সময় বিকেল পাঁচটা ১২ মিনিট। সারা
পৃথিবীতে এ সময়টি ঘিরে উত্তেজনা। জল্পনা-কল্পনা। পৃথিবী নাকি ধ্বংস হয়ে
যাবে? পৃথিবী ধ্বংসের গল্প নতুন নয়। কিন্তু কোনো সময়ই তা ঠিক হয়নি। এবার
মায়া সভ্যতার দিনপঞ্জিকে ঘিরে কেউ কেউ বলছেন, পৃথিবীর শেষ দিন শুক্রবার। আর
বিজ্ঞানীরা বলছেন, এগুলো মানুষের কল্পনা আর ব্যবসায়িক নতুন ফন্দি ছাড়া আর
কিছুই নয়। পৃথিবী ধ্বংস হবে না।
কেন ২১ ডিসেম্বর ২০১২?
বর্তমান মেক্সিকোর দক্ষিণাঞ্চল, ক্যালিফোর্নিয়া, বেলিজ এবং হন্ডুরাস ও এল সালভাদরের কিছু অংশজুড়ে বিস্তৃতি ছিল মায়া সভ্যতা। জ্যোর্তিবিদ্যা, সংস্কৃতিসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে বেশ উন্নত ছিল। মায়ান যুগের শুরু আগস্ট ১১, ৩১১৪ খ্রি. পূ.। মায়া সভ্যতার দিনপঞ্জি অনুযায়ী এক লাখ ৪৪ হাজার দিনে (প্রায় ৪০০ বছর) এক বাকতিউন। ১৩ বাকতিউনে হয় পাঁচ হাজার ১২৫ বছর। এই সময় শেষ হবে ২১ ডিসেম্বর ২০১২। কিন্তু এরপর তাদের দিনপঞ্জিতে আর কোনো দিনের অস্তিত্ব নেই। তাই এ দিনটি ঘিরে যত সব কল্পনা-জল্পনা। কেউ কেউ বলছেন, হয়তো পৃথিবীর সঙ্গে কোনো গ্রহাণুর সংঘর্ষ হবে। মায়া সভ্যতার গবেষক মার্ক ভন স্টোনের মতে, মায়া ও অ্যাজটেক—কোনো সভ্যতাতে সরাসরি পৃথিবী ধ্বংসের কথা বলা হয়নি।
বিজ্ঞান কী বলে?
নাসা বলছে, জল্পনা-কল্পনার শুরু ২০০৩ সালে। সুমেরিয়ানদের কল্পিত নিবিরু নামের গ্রহটি ওই বছর মে মাসে পৃথিবীতে আঘাত হানবে। এর ফলে ধ্বংস হবে পৃথিবী। কিন্তু তখন কিছুই হয়নি। এর পরই শুরু হয় মায়া সভ্যতার দিনপঞ্জি নিয়ে কল্পনা। ২০১২ সালের ২১ ডিসেম্বরের পর ওই দিনপঞ্জিতে কোনো দিন নেই বলে অনেকেই বলতে শুরু করেন, ওই দিন নিবিরু আঘাত হানবে। কিন্তু এমন গ্রহের কোনো অস্তিত্বই নেই।
ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক নিউজ, হাফপোস্ট হোম, নাসা।
পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যাবে- এটি একটি বহু পুরনো পাবলিক ক্রেজ। এবং এই ক্রেজই ছিল ক্রসেডের অন্যতম একটি কারণ। মধ্যযুগে খ্রিস্টীয় জগতে বিশ্বাস করা হত যে ১০০০ সালে পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যাবে। এই বিশ্বাসকে Millenarianism বা millenarism বলে। Millenarism is the belief by a religious, social, or political group or movement in a coming major transformation of society, after which all things will be changed, based on a one-thousand-year cycle.দশম শতক ঘনিয়ে এলে ইউরোপের খ্রিস্টানরা পবিত্র জেরুজালেম জীবনের অন্তিম মুহূর্ত অতিবাহিত করতে চাইল । নগরটি তখন মুসলিম মুরদের দখলে। তারা খ্রিস্টানদের বাধা দিলে লড়াই (ক্রসেড) শুরু হয়ে যায়।
অনেকের ধারণা ২০১২ সালে পৃথিবীতে নিবিরু গ্রহটি আছড়ে পড়বে।
অনেকেরই ধারণা ২০১২ সালে পৃথিবীতে নিবিরু গ্রহ আছড়ে পড়বে। নিবিরু গ্রহটি নাকি প্রাচীন সুমেরিয়দের আবিস্কার। সেটিই নাকি পৃথিবীর দিকে ধেয়ে আসছে। লেখক জাকারিয়া সিটচিন মেসোপটেমিয়ার পটভূমিতে কল্পকাহিনীর লেখেন। তার লেখায় রয়েছে নিবিরু গ্রহটি ৩৬ হাজার বছরে একবার সূর্যকে প্রদক্ষিণ করে। এই মনগড়া তথ্যের ওপর ভিত্তি করে স্বঘোষিত সাইকি ন্যান্সি লেইডার দাবি করে বসলেন তার সঙ্গে ভিন গ্রহের বুদ্ধিমান প্রাণির যোগাযোগ আছে। এবং নিবিরু গ্রহটি পৃথিবীতে আছড়ে পড়বে। ন্যান্সি লেইডার সংঘর্ষের তারিখ ২০০৩ সালের মে মাস নির্ধারণ করেন। ২০০৩ সালে যখন কিছুই ঘটল না, তখন তিনি তারিখটি আবার ২০১২ সালের ডিসেম্বর মাসে তারিখটি পুর্ণনির্ধারণ করেন। এর কারণ কি? মায়া সভ্যতার প্রতি মানুষের রহস্যময় আকর্ষণ।
দক্ষিণ আমেরিকার মায়া সভ্যতার মানচিত্র। মায়া সভ্যতার সময়কাল ২৫০ থেকে ৯০০ খ্রিস্টাব্দ। সভ্যতাটির ব্যাপ্তি ছিল দক্ষিণ মেক্সিকো, গুয়েতেমালা, বেলিজ, এল সালভাদর এবং হন্ডুরাসের কিছু অংশ। প্রত্নতাত্ত্বিকগণ মায়াসংস্কৃতির বিভিন্ন দিক সম্বন্ধে গবেষনা করেছেন । এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল মায়াদের লিখনপদ্ধতি আবিস্কার করা।
মায়ারা প্রধানত দুটি ক্যালেনডার ব্যবহার করত। একটি হল- ‘দীর্ঘ গণনা’ বা ‘লং কাউন্ট’। এটি অতীত এবং ভবিষ্যৎ ঘটনা সর্ম্পকিত। অন্য ক্যালেনডারটি ছোট, যার ব্যাপ্তি ৫২ বছর। এটি ‘ক্যালেনডার রাউন্ড’ নামে পরিচিত। এর সময়সীমা একজন ব্যাক্তির জীবৎকাল। লং কাউন্ট- এর সূচনা ৩১১৪ খ্রিস্টপূর্ব। এবং এটি ৫১২৬ বছর পর অর্থাৎ শেষ হয়েছে ২০১২ খ্রিস্টাব্দের ২১ ডিসেম্বর। এই কারণেই রহস্যের সৃষ্টি হয়েছে।
মায়া দীর্ঘ গণনা বা লং কাউন্ট ক্যালেনডার। মায়াদের ক্যালেনডার সর্ম্পকে নাসার বিজ্ঞানী ড. ডেভিড মরিসন মন্তব্য করেছেন:The Mayan astronomers were clever, and they developed a very complex calendar. Ancient calendars are interesting to historians, but of course they cannot match the ability we have today to keep track of time, or the precision of the calendars currently in use.
স্বাভাবিক কারণেই ঐতিহাসিকরা মায়া ক্যালেনডার- এর সঙ্গে গ্রেগরিয়ান ক্যালেনডার- এর সমন্বয় সাধন বা 'কোরিলেট' করেছেন । নইলে মায়া ইতিহাস মায়াদের জগতের বাইরে বোধগম্য হবে না। সমস্যার মূল এটিই। প্রত্ন
তাত্ত্বিকগন মায়া ইতিহাসের বিভিন্ন পর্যায় বর্ননা করার সময় মায়া ক্যালেনডার কে গ্রেগরিয়ান ক্যালেনডার এ রূপান্তরিত করতে GMT কোরিলেশন পদ্ধতি অনুসরণ করেছেন। GMT হল তিনজন প্রত্নতত্ত্ববিদের নামের আদ্যক্ষর। এরা হলেন জোসেফ গুডম্যান, জুয়ান মার্টিনেজ -হার্নান্ডেজ এবং জে. এরিক এস থম্পসন। তবে GMT -র নির্ভরযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। এদের মধ্যে ইউনিভার্সিটি অভ ক্যালিফোর্নিয়ার (সান্তা বারবারা) অধ্যাপক জেরাল্ডো আলডানা অন্যতম। তিনি GMT -র যথার্থতা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন। যেমন একজন ইউরোপীয় গবেষক লিখেছেন: গুয়েতেমালার মায়া রাজা চাক এক- এর উদয়ের সময় যুদ্ধ শেষ করেন। এত দিন ধারণা ছিল চাক এক হল শুক্র গ্রহ। অধ্যাপক আলডানা ধারণা করছেন চাক এক হল উল্কা। আমরা জানি, মায়ারা জ্যোতিবিজ্ঞান চর্চা করত । চাঁদের কলা, গ্রহন এমন কী শুক্র গ্রহের আন্দোলন অবধি তারা অবগত ছিল। শুক্র গ্রহের আবর্তনের সঙ্গে মায়া ক্যালেনডার সর্ম্পকিত ।
মায়াদের নিয়ে মানুষের অনেক রহস্যময়তা ছড়িয়েছে। বলা হয় মায়া সভ্যতার উত্থান নাকি আকস্মিক এবং ১২০০ শতকে সভ্যতাটি আকস্মিকভাবে 'ভ্যানিশ' হয়ে যায়। আসলে মায়া সভ্যতার পতনের অন্যতম কারণ ছিল অনাবৃষ্টি এবং বনভূমি উজার হয়ে যাওয়া।
এভাবে GMT কোরিলেশন পদ্ধতি অনেকবারই ভুল প্রমাণিত হয়েছে। অথচ এতসব অসংগতির পরও ২০১২ সালের ২১ ডিসেম্বরই যে পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে সে ব্যাপারে অনেকেই নিশ্চিত। তার কারণ কি? স্বার্থান্বেষী মহল টিকিয়ে রাখছে অর্থনৈতিক স্বার্থেই। এ প্রসঙ্গে ডিসকভারি নিউজ এর আয়ান ও নিল লিখেছেন: After all, proving that the world isn't going to end is bad for business if you have a doomsday book to sell.আর নাসার বিজ্ঞানী ড. ডেভিড মরিসন বলছেন,Calendars exist for keeping track of the passage of time, not for predicting the future. The main point, however, is that calendars, whether contemporary or ancient, cannot predict the future of our planet or warn of things to happen on a specific date such as 2012. I note that my desk calendar ends much sooner, on December 31, 2009, but I do not interpret this as a prediction of Armageddon. It is just the beginning of a new year.
মায়াদের টরটুগুয়েরো নগরে ইংরেজি টি-আকারের ৬নং স্মৃতিস্তম্ভ
যে নিয়ে তারিখটি নিয়ে পৃথিবীজুড়ে এত জল্পনাকল্পনা চলছে সেটি কোথায় রয়েছে? ৭০০ শতকের মায়াদের টরটুগুয়েরো নগরে একটি স্মৃতিস্তম্ভ আবিস্কৃত হয়েছে । ইংরেজি টি-আকারের ৬নং মনুমেন্ট নামে পরিচিত। এর ওপর খোদিত আছে 'দীর্ঘ গণনার' একটি তারিখ (৯.১১.১৬.৮.১৮) । এটি আসলে ভবন নিমার্ণের তারিখ। এরপর মায়ান ভাষায় লেখা: ‘জুহটজুম উ ১৩ বাখতুন ৪ আজাও ৩ কানকিন উতুম।’ এই লাইনটি ১৩ বাখতুন (ডিসেম্বর ২১, ২০১২)- এর পরের ভবিষ্যতের কোনও ঘটনাকে নির্দেশ করছে। এর পর লেখা রয়েছে তখন বোলোন য়ুকটে (দেবতাগন) আবিভূর্ত হবেন। লিপিটি ভগ্ন বলে আর কিছু বোঝা যায়নি। তবে পৃথিবী যে ২০১২ সালের ২১ ডিসেম্বর ধ্বংস হয়ে যাবে সেরকম ভবিষ্যৎবাণী মায়ারা করেনি।
না, শায়মা আপা, ২০১২ সালের ২১ ডিসেম্বর পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে না।
তবে পৃথিবী ধ্বংস হবে ঠিকই যখন ৪ বিলিয়ন বছর পর সূর্যের ভিতরে হাইড্রোজেন নিঃশেষ হয়ে যাবে। ভারী উপাদান জ্বালাতে জ্বালাতে বেলুনের মতো ফুলে যাবে সূর্যটা । আর সৌরজগতের সব গ্রহকে গিলে খাবে।তখনই পৃথিবী পুড়ে ছাই হয়ে যাবে। সেসবের তো অনেক দেরি। কাজেই আগামী বছর কিছুই হচ্ছে না। যদিও অনেকে বিশ্বাস করছে এবং ভয় পাচ্ছে। আগেও একবার বলেছি, এর পিছনে রয়েছে অর্থনৈতিক স্বার্থ। একজন লেখক এ বিষয়ে মন্তব্য করেছেন: Doomsayers with YouTube accounts and producers with multi-million dollar budgets are profiting from tales of doomsday.
অনেকেরই অলীক বিশ্বাস যে ২০১২ সালের ২১ ডিসেম্বর নিউ ইর্য়কের পিস অভ লিবার্টি ধ্বংস হয়ে যাবে। বেশির ভাগ মানুষই আসলে তলিয়ে দেখে না। তারা হুজুগে মাতে। হয়তো বিশ্বব্যাপী বিপর্যয়ের ভাবনাটি তাদের নিরানন্দ জীবনে রোমাঞ্চকর অনুভূতি এনে দেয় ...
পৃথিবী ধ্বংসের বিষয়টি ধর্মীয় বোধে পর্যবেশিত হয়েছে
অনেকের মধ্যে Millenarianism বোধটিও প্রবল ...
বিশ্বের দেশে দেশে সাধারণ মানুষের মাঝে এই নিয়ে শুরু হয়েছে জল্পনা, কল্পনা ও চিন্তা-ভাবনা। সত্যিই কি ধ্বংস হয়ে যাবে পৃথিবী? বিজ্ঞানীদের ধারনা আবার অনেক বিজ্ঞানীর অগাধ বিশ্বাস যে, এই ২০১২ সালের ডিসেম্বরের ২১ তারিখই ধ্বংস হয়ে যাবে পৃথিবী। তাদের ধারনা অনুযায়ী পৃথিবী ধ্বংস হবে প্রাকৃতিক ধ্বংসযজ্ঞে বা মানুষের নিজেদের ভুলে। পৃথিবী ধ্বংসের তারিখ ঘোষণা নতুন নয়, এর আগে ২০০০ সালের ৫ মে তারিখকে বিজ্ঞানীরা পৃথিবী ধ্বংসের তারিখ হিসেবে ঘোষণা করেছিল। তবে সেদিন পৃথিবী ধ্বংস হওয়া তো দূরের কথা সেদিন পৃথিবীর কোথাও সামান্যতম দুর্ঘটনাও ঘটেনি। তবে এবার তাদের যুক্তি আরও প্রবল। আর এই বিশ্বাসকে ছড়ানো হচ্ছে বিশ্বব্যাপী মানুষের মাঝে। বিশ্বাসকে মানুষের মাঝে জোরালো করার জন্য ইতোমধ্যে 2012 নামে একটি সিনেমা তৈরি করা হয়েছে। অনলাইনের অনেক ওয়েব সাইট আবার ২১ ডিসেম্বরের দিনকে কেন্দ্র করে ক্ষণ গণনা শুরু করেছে। তাহলে কি ২০১২ সালই হবে পৃথিবীর শেষ বছর! আসুন আমরা একটু গভীরে গিয়ে রহস্যটা বোঝার চেষ্টা করি।
২০১২ সালে পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যাবে এই কথাটা বিশ্বব্যাপী প্রচার করা হয়েছে মূলত ছয়টি যুক্তিকে কেন্দ্র করে। যেগুলো হলো, মায়াদের ক্যালেন্ডার, সুমেরীয়দের তত্ত্ব, সূর্যঝড়, সুইজারল্যান্ডের লার্জ হ্যাড্রন কোলাইডার, ভয়ঙ্কর অগ্নুৎপাত ও পবিত্র বাইবেলের ঘোষণা। আসুন আমরা প্রথমে পৃথিবী ধ্বংসের যুক্তিগুলোর সাথে পরিচিত হয়ে নেই।
(১) মায়াদের ক্যালেন্ডার: ২০১২ সালে পৃথিবী ধ্বংস হওয়ার প্রধান যে যুক্তি সেটি হচ্ছে মায়াদের বর্ষপঞ্জি। সভ্যতার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নিদর্শন ছিল ২০০০ বছর আগেকার মায়া সভ্যতা। ২৫০ থেকে ৯০০ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে মেক্সিকো ও মধ্য আমেরিকার বিশাল অঞ্চল জুড়ে বিকাশ লাভ করেছিল এই মায়া সভ্যতা। সেই সময় মায়ারা তৈরি করেছিল এক রহস্যময় ক্যালেন্ডার। মায়াদের সময় বিশ্বজুড়ে স্থাপত্য, সংস্কৃতি আর বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে অগ্রগতি ছিল নজিরবিহীন। প্রাচীন মিথ, জ্যোতিষশাস্ত্র কিংবা প্রাচীন বুদ্ধিমান সভ্যতার ওপর যাদের আস্থা চরম তাদের প্রথম পছন্দ মায়া সভ্যতা। এই সভ্যতার আরও অনেক নিদর্শনের মধ্যে রয়েছে এর কয়েক হাজার বছর ধরে চলা বর্ষপঞ্জি। দক্ষিণ আমেরিকায় ইউরোপীয় উপনিবেশ স্থাপনের আগে এই বর্ষপঞ্জি অনুসরণ করত এ অঞ্চলের মানুষ। পরে গ্রেগরিয়ান বর্ষপঞ্জি চালু হয়ে যায়। সেই বিখ্যাত মেসো আমেরিকান লং কাউন্ট ক্যালেন্ডার পাঁচ হাজার ১২৫ বছরের বৃত্ত শেষ করছে এ বছরের ২১ ডিসেম্বর। সবচেয়ে বড় ভয়ংকর ব্যাপার হলো, মায়া পঞ্জিকাতে আজ পর্যন্ত যত ভবিষ্যদ্বাণী করা হয়েছে তার প্রতিটিই কালের আবর্তে সত্য ঘটনায় পরিণত হয়েছে। আর এ কারণেই পৃথিবী ধ্বংসের আশংকা নিয়ে এত বেশী আলোচনা হচ্ছে। অধিকাংশ প্রাচীন সভ্যতায় উল্লেখ থাকে যে, অলৌকিক ক্ষমতাসম্পন্ন কেউ একজন দূর থেকে আমাদের নিয়ন্ত্রণ করছেন। জীবনের প্রতিটি খুঁটিনাটি ঘটনা সেই একজনের বিশাল বড় এক ঐশ্বরিক প্ল্যানের অংশ বিশেষ। আর প্রাচীন সভ্যতায় উল্লেখিত এই ঐশ্বরিক প্ল্যান বুঝতে পারার জন্য পৃথিবীর একমাত্র উপায় এই মায়ান পঞ্জিকা। কিন্তু কী আছে মায়ান ক্যালেন্ডারে ? জিনিসটাই বা কি? পুরাতন সেই মায়ান সভ্যতা ইতিহাসের এক অনুপম সৃষ্টি। সময় এবং সৃষ্টির সুন্দর বিন্যাস সম্পর্কে মায়ানরা অনেক আগেই অবগত ছিলেন। তাদের ছিল ভবিষ্যৎ জানার নান্দনিক ক্ষমতা। মায়ানরা আগে থেকেই জানতো যে চাঁদ, শুক্র এবং অন্য গ্রহ গুলো মহাবিশ্বে চকরাকারে ঘুরছে। সেই সময়েই তারা নিখুঁতভাবে সময় গণনা করতে পারত। তাদের একটি পঞ্জিকা ছিল যাতে সৌর বছরের প্রতিটি মিনিটের নিখুঁত বর্ণনা ছিল। মায়ানরা মনে করত প্রতিটি জিনিসের উপর সময়ের প্রভাব রয়েছে এবং প্রতিটি জিনিস একেক সময় একেকটি অবস্থানে বিরাজ করছে। মায়ানদের কাছে মহাকাশের উপর ২২টি ভিন্ন ভিন্ন পঞ্জিকা ছিল। এর মধ্যে কোন কোনও পঞ্জিকা এখন থেকে ১০ মিলিয়ন বছর আগের। আর সেগুলো এত দুর্বোধ্য যে তা বুঝতে চাইলে হিসাব-নিকাশ করার জন্য সঙ্গে অবশ্যই একজন করে এস্ট্রোনমার, এস্ট্রোলজার, জিওলজিস্ট এবং ম্যাথমেটিশিয়ান থাকতে হবে। অধিকাংশ আর্কিওলজিস্ট মনে করেন মায়ানরা খ্রিস্ট জন্মের প্রায় ৩ হাজার ১১৪ বছর আগে থেকে সময় গণনা করা শুরু করেছে। আমাদের বর্তমান পঞ্জিকা মতে খ্রিস্টের জন্মের বছরের জানুয়ারি মাস থেকে প্রথম বছর গণনা করা হয়। আর মায়ান ক্যালেন্ডার অনুযায়ী এই বছরটাকে হিসাব করা হয় শূন্য বছর। এই সময়টাকে লেখা হয় এভাবে :০-০-০-০-০। একটা নতুন চক্র শুরু হওয়ার আগের ১৩ চক্রে ৩৯৪ বছর শেষ হয়ে যাবে। আর নতুন চক্রটি শুরু হবে ২০১২ সালের। সবচেয়ে আশংকার ব্যাপার হলো ২০১২ সালের ২১ ডিসেম্বরের পর থেকে মায়ান পঞ্জিকাতে আর কোনও দিনের উল্লেখ নেই। তাই এই দিনটিকে মনে করা হচ্ছে পৃথিবীর সর্বশেষ দিন। আর একটি বিষয় হলো আজ পর্যন্ত মায়ান পঞ্জিকাতে যা-ই ভবিষ্যদ্বাণী করা হয়েছে, তার প্রতিটি কথা অক্ষরে অক্ষরে প্রতিফলিত হয়েছে। আজকের বিজ্ঞানের চরম উৎকর্ষতা থেকে শুরু করে বিজ্ঞানের সব গুরুত্বপূর্ণ উত্থানের উল্লেখ মায়ানদের ক্যালেন্ডারে আগে থেকেই ছিল। তাই বিশ্বের বাঘা বিজ্ঞানীরাও ২০১২ সালের ২১ ডিসেম্বরে পর থেকে কী ঘটতে পারে তাই নিয়ে দুশ্চিন্তায় আছেন। বর্তমানে মানুষের চিন্তা-চেতনা এবং ধ্যান-ধারণায় অনেক পরিবর্তন এসেছে। সময় এবং বিজ্ঞান সম্পর্কিত জ্ঞানের বিষয়ে মধ্য আমেরিকার মায়ান সভ্যতাই সবচেয়ে বেশি এগিয়ে ছিল এবং আছে। সমগ্র পৃথিবীর মধ্যে তাদের পঞ্জিকাই সবচেয়ে বেশি নিখুঁত। আজ পর্যন্ত কেউ এর কোনও খুঁত খুঁজে পায়নি।
(২) সুমেরীয়দের তত্ত্ব: ২০১২ সালে পৃথিবী ধ্বংসের পিছনে কারণ হিসেবে দেখানো হচ্ছে সুমেরীয়দের আবিষ্কৃত গ্রহ নিবিরু আর পৃথিবীর কক্ষপথ একই রেখায় চলে আসার তত্ত্ব। বলা হয়েছে এ দুই গ্রহের মুখোমুখি সংঘর্ষ হবে আবার যদি পুরোপুরি নাও হয় তবে পৃথিবীর একটা অংশ ছুঁয়ে যাবে। তা ছাড়া নিবিরু পৃথিবীর কাছাকাছি চলে আসার ফলে দুই গ্রহের মাধ্যাকর্ষণ শক্তির ঘাত-প্রতিঘাত পৃথিবীর গতিতেও এনে দেবে পরিবর্তন। কেউ কেউ প্রমাণ হিসেবে নাসার একটি পূর্বাভাসকেও ব্যবহার করছে। যেখানে বলা হচ্ছে, ২০১২ সালে সূর্য তুলনামূলক ভাবে বেশি উত্তপ্ত থাকবে। এ সময় ‘সোলার ফ্লেয়ার’ বা সূর্যের মধ্যে বিস্ফোরণের পরিমাণ বেড়ে যাবে। পৃথিবী ধ্বংসের এই ধারনাকে আরও উসকে দিয়েছে ২০০৯ সালে মুক্তি পাওয়া 2012 নামের একটি ছবি। যেখানে দেখানো হয়েছে, সূর্যের উত্তাপ বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে পৃথিবীর কেন্দ্রের উত্তাপও ভয়ংকর ভাবে বেড়ে যাচ্ছে। এর ফলে গলে যাচ্ছে পৃথিবীর ভূখণ্ড। পৃথিবীতে আর ভূখণ্ড বলে কিছু থাকছে না। পুরো পৃথিবী তলিয়ে যাচ্ছে পানির নিচে।
(৩) সূর্যঝড়: সানস্ট্রম বা সূর্যঝড়কে বিজ্ঞানীরা পৃথিবীর ভবিষ্যতের জন্য একটি ভয়ঙ্করতম হুমকি বলে মনে করছেন। সূর্যের ভেতরে প্রতিনিয়ত নানা ধরনের বিস্ফোরণ থেকে তৈরি হয় এনার্জি। আর সেই এনার্জি থেকে ইলেকট্রন, প্রোটনের মতো নানা পার্টিকল পৃথিবীতে এসে পৌছায় এবং এগুলোর ক্ষতিকর প্রভাব এসে পড়ে পৃথিবীর উপর। সেই সঙ্গে সোলার র্স্ট্রম বা সৌরঝড় তো রয়েছেই। ২০১২ সালে সূর্যের সবচেয়ে বেশি পরিমাণ এনার্জি তৈরি হবে, যার নাম ‘সোলার ম্যাক্সিমাম’। এই সৌরঝড়ের ভয়ংকর রেডিয়েশন এবং এনার্জি নির্গমনের ফলে ভূপৃষ্ঠে বা মহাকাশে যোগাযোগ ব্যবস্থা ও অন্যান্য ক্ষেত্রে নানা সমস্যা দেখে দিবে। বেড়ে যেতে পারে মানুষের অসুখ বিসুখ, দুর্ঘটনা ও ভয়াবহ সব প্রাকৃতিক দুর্যোগ। ফলে পৃথিবী এগিয়ে যাবে চূড়ান্ত পরিণতির দিকে।
(৪) লার্জ হ্যাড্রন কোলাইডার: পৃথিবীর জন্য আরেকটি সম্ভাব্য হুমকি হচ্ছে লার্জ হ্যাড্রন কোলাইডার’। পৃথিবীর জন্মমুহূর্তে পৌঁছাতে সুইজারল্যান্ডের জেনেভায় মাটির নিচে তৈরি করা হয়েছে মানুষের তৈরি সবচেয়ে বড় যন্ত্র লার্জ হ্যাড্রন কোলাইডার। বিগ ব্যাংয়ের সময় মহাবিশ্বের জন্মলগ্নে পৃথিবী কি রকম ছিল তা জানতে ২৭ কি. মি. লম্বা জোড়া পাইপের ভেতর দিয়ে বিজ্ঞানীরা প্রোটনকে কোটি কোটি বার চক্কর খাওয়াবে এখানে। তারপর প্রায় আলোর গতির কাছাকাছি পৌঁছে বিপরীতমুখী প্রোটনের সঙ্গে ভয়ঙ্কর ধাক্কা খেয়ে ভেঙ্গে টুকরো টুকরো হয়ে তৈরি হবে ডট্রিলিয়ন ডিগ্রি (১০০,০০০,০০০,০০০) সেন্টিগ্রেড উত্তাপ। মাল্টিপেক্সড এনালগ সিগন্যাল প্রসেসরে জমা হতে থাকবে অগণিত তথ্য। সেই তথ্য বিশ্লেষণ করে বিজ্ঞানীরা জানবেন পৃথিবী সৃষ্টির রহস্য। এই পরীক্ষাটি আগে একবার চালানো হলেও সেটি ব্যর্থ হয়েছিল। ২০১২ সালে পরিপূর্ণভাবে চালানোর কথা আছে এই পরীক্ষাটি। এটিই হবে বিজ্ঞানের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও ঝুঁকিপূর্ণ পরীক্ষা। কারণ এর ফলে ঘটতে পারে ভয়ংকর দুর্ঘটনা।
(৫) ভয়ঙ্কর অগ্নুৎপাত: পৃথিবীর সবচেয়ে ভয়ংকর আগ্নেয়গিরি হলো আমেরিকার ইয়েলোস্টোন ভলকানো। মোটামুটি প্রতি ৬,৫০,০০০ বছর পর পর ভয়ংকর অগ্ন্যুৎপাত হয় এই আগ্নেয়গিরি থেকে। গবেষণা অনুসারে ২০১২ সালে ভয়ংকর বিস্ফোরণ ঘটবে আবার ইয়োলো স্টোনে। হয়তো সেখান থেকে এমন ভয়াবহ অগ্ন্যুৎপাত হবে যাতে পৃথিবীর সব বায়ু মণ্ডল ঢেকে যাবে এবং ছাইয়ে চাপা পড়ে যাবে সূর্যও। তখন গোটা পৃথিবী অন্ধকারে ঢেকে যাবে। এভাবে কিছু দিন চললেই পৃথিবী থেকে প্রাণের স্পন্দন থেমে যাবে। আবার এই অগ্ন্যুৎপাতের ফলে পৃথিবীর তাপমাত্রা মারাত্মকভাবে বৃদ্ধি পেয়ে পৃথিবীর অন্যান্য আগ্নেয়গিরিগুলো জীবিত হয়ে তৈরি করতে পারে নতুন কোনও বিগ ব্যাং।
(৬) বাইবেলের ঘোষণা: পবিত্র বাইবেলে বলা হয়েছে পৃথিবীতে ভাল-মন্দের লড়াই সার্বজনীন। এবং ভাল-মন্দের চূড়ান্ত বিচার বা লড়াইয়ের একটা শেষ পরিণতি থাকে। আর সেই শেষ পরিণতির সময় হিসেবে ২০১২ সালের দিকে ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছে। ‘The I Ching’ নামের চীনা এক গ্রন্থেও এই বিষয়ের কথাটির উল্লেখ পাওয়া যায়।
এতক্ষণ আমরা পৃথিবী ধ্বংসের কারণগুলোর সাথে পরিচিত হলাম। এই কারণগুলো দ্বারা তাহলে কি আপনার মনে হচ্ছে পৃথিবী সত্যিই ২০১২ সালে ধ্বংস হয়ে যাবে? তাহলে আসুন এবার এর উত্তর খোজা যাক।
(১) মহাপ্রলয়ের এমন ভবিষ্যদ্বাণী অনেক বার করা হয়েছে অতীতে। তখন দেখা যেত অন্ধ বিশ্বাসী মানুষেরা ঘটিবাটি নিয়ে দলে দলে উঠে যেত উঁচু পাহাড়ের গায়ে যাতে মহাপ্রলয় থেকে রক্ষা পেতে পারে। এবারও তেমনিভাবে ছড়ানো হয়েছে তেমনই একটি ভবিষ্যদ্বাণী। যা দ্রুত ছড়িয়ে পড়েছে বিশ্বব্যাপী। এবার গুঞ্জন ছড়ানো হয়েছে যে পৃথিবী ধ্বংসের এই দিনটি হিসাব নিকাশ করে বের করেছে প্রাচীন মায়া সভ্যতার পুরোহিতরা এবং সেটা ভুল হবার নয়। ২০১২ সালের ২১ ডিসেম্বরই যে পৃথিবীর শেষ দিন তার প্রমাণ মায়াদের ক্যালেন্ডার বা বর্ষপঞ্জি, কারণ ঐদিন শেষ হয়ে গেছে তাদের ক্যালেন্ডার। কিন্তু সমস্যা একটাই। প্রাচীন মায়ার পুরোহিতরা কখনও এমন ভবিষ্যদ্বাণী করেনি। বিজ্ঞানও এটা সমর্থন করেনি। মায়া সভ্যতার স্বর্ণযুগ ছিল ২৫০ থেকে ৯শ' খ্রিস্টাব্দ। সে সময়কার জ্ঞান-বিজ্ঞান, শিল্প-সাহিত্য ও স্থাপত্যের অসাধারণ নিদর্শন হিসেবে মায়াদের হাজার হাজার শিল্পকর্ম ও হাইরোগ্লিফ বা চিত্র লেখার অস্তিত্ব আছে। তা থেকে অন্তত এইটুকু জানা যায় যে, পুনর্জন্ম ও পুনঃ সৃষ্টি নিয়ে মায়াদের মধ্যে আচ্ছন্নতা ছিল। কিন্তু ভবিষ্যতের কোন আলামত নিয়ে নয়। মায়াদের লোককাহিনীতে অতীত জগতের বিবরণ আছে। কিন্তু বর্তমান জগত কখন কিভাবে শেষ হয়ে যাবে কিংবা আদৌ হবে কি না সে সম্পর্কিত কোন বিবরণ নেই।
তারপরও মায়া পুরোহিতদের ভবিষ্যদ্বাণী বলে যা বলা হচ্ছে তা একটু খতিয়ে দেখলেই আসল রহস্যটা জানা যাবে। মায়ারা সময়কে মহাপ্রলয়ের দিকে টিক টিক করে এগিয়ে চলা ঘড়ি মাত্র হিসেবে দেখত না বরং অনন্ত চক্রের এক জটিল ব্যবস্থা হিসেবে মনে করত। এসব চক্রের একটি ছিল 'মায়া লং কাউন্ট' যার মেয়াদ ছিল ৫ হাজার বছরেরও বেশি। আমাদের ক্যালেন্ডারে সেই চক্র শুরু হয়েছিল খ্রিস্টপূর্ব ৩১১৪ সালের আগস্ট মাসে এবং তা শেষ হবার কথা ২০১২ সালের ২১ ডিসেম্বর মায়া সংখ্যাতত্ত্ব অনুযায়ী যা ১৩.০.০.০। যেহেতু ২১ ডিসেম্বর মায়া বর্ষপঞ্জির ঐ চক্রের শেষ তাই ঐ দিনটাকে পৃথিবী ধ্বংসের দিন বলে অপব্যাখ্যা করা হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে এমন মনে করার কোন কারণ নেই যে, মায়ারা ভেবেছিল ঐ দিনই পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যাবে। ২১ ডিসেম্বর মায়া ক্যালেন্ডারের একটি চক্রের শেষ হলেও পরের দিন অর্থাৎ ২২ ডিসেম্বর থেকে মায়া বর্ষপঞ্জির নতুন একটি চক্র শুরু হবার কথা। নিউইয়র্কের কোলগেট বিশ্ববিদ্যালয়ের মায়া সভ্যতার বিশেষজ্ঞ ডেভিড স্টুয়ার্ট বলেছেন, মায়ার লম্বা বর্ষপঞ্জি শেষ হয়ে যাচ্ছে ঠিকই, কিন্তু পরের দিন শেষে আবারও মায়ার লম্বা বর্ষপঞ্জির নতুন যাত্রা শুরু হবে, ঠিক যেমন ৩১ ডিসেম্বর শেষে আমরা ঘরের দেয়ালে পুরনো বর্ষপঞ্জি ফেলে দিয়ে নতুন বর্ষপঞ্জি টানিয়ে দেয়। কাজেই ২১ ডিসেম্বর কোনভাবেই শেষ দিন নয়।
তাহলে মহাপ্রলয়ের এই ধারণার উৎপত্তি হলো কিভাবে? মেঙকোর তরতুগুয়েরো নামক জায়গায় একবার মায়া যুগের একটা চিত্রলেখর সন্ধান পাওয়া যায়। সেটা ছিল এক প্রস্তর ফলকে উৎকীর্ণ শব্দাবলী। তাতে ১৩.০.০.০ তারিখটির উল্লেখ ছিল। ১৯৯৬ সালে মায়া বিশেষজ্ঞরা সেটা পাঠ করে দ্ব্যর্থবোধক ব্যাখ্যা দেন। তাঁরা বলেন, সম্ভবত এক অশুভ ঘটনার ইঙ্গিত। হয়ত অন্ধকার জগতের কোন দেবতার আবির্ভাব ঘটবে এ দিনে। তাঁরা এই ব্যাখ্যা অনলাইনে দিয়ে দেন। পরবর্তী বছরগুলোতে তা ইন্টারনেট জুড়ে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। ২০১২ সালে মহাপ্রলয়ের ধারণার প্রবক্তারা এটাকে মায়াদের ভবিষ্যদ্বাণীর প্রমাণ হিসেবে লুফে নেন। কিন্তু প্রস্তরফলকে উৎকীর্ণ লিপির বিশেষজ্ঞরা ওই চিত্রলেখার চুলচেরা বিশ্লেষণ করে ভিন্ন ভিন্ন ব্যাখ্যা হাজির করেন। তাদের সর্বসম্মত মত হলো মায়া চিত্রলিপিটি পৃথিবী ধ্বংসের কোন ভবিষ্যদ্বাণী ছিল না। ঐ প্রস্তর ফলকে মায়ারা বলেনি ২১ ডিসেম্বর ২০১২ তারিখ পৃথিবী শেষ হয়ে যাবে।
(২) সুমেরীয়দের আবিষ্কৃত গ্রহ নিবিরু আর পৃথিবীর কক্ষপথ একই রেখায় চলে আসার তত্ত্ব নিয়ে বিশ্বব্যাপী মানুষের মাঝে শুরু হয়েছে চিন্তা, ভাবনা ও আতংক। ব্যাপারটি এমন হয়ে দাঁড়িয়েছে যে, প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষ নাসার কাছে এ বিষয়ে জানতে চেয়ে চিঠি পাঠাচ্ছে। কেউ কেউ এমনও মন্তব্য করেছেন যে, ওই বিভীষিকা শুরুর আগেই তাঁরা সপরিবারে আত্মহত্যা করবেন! ভেবে দেখুন অবস্থাটা কোন পর্যায়ে গিয়ে দাঁড়িয়েছে। জনগণের মধ্যে আতংক দেখে বাধ্য হয়ে নাসা এ নিয়ে একটি বিশেষ ওয়েবসাইট খুলে সেখানে বৈজ্ঞানিক যুক্তিতর্ক দিয়ে মানুষকে আশ্বস্ত করছে যে, পৃথিবী অন্তত এ বছরেই ধ্বংস হয়ে যাওয়ার কোনও কারণ নেই। বর্তমান নাসার বিজ্ঞানীরা বলেছেন, সুমেরীয়দের আবিষ্কৃত তত্ত্বটি ছিল অনুমান নির্ভর। কারণ, তাদের সময় বৈজ্ঞানিক অগ্রগতি বর্তমান সময়ের মতো আধুনিক ছিল না। জ্ঞান-বিজ্ঞানের প্রতি তাদের প্রবল আগ্রহ ছিল সেজন্য তারা বেশ কিছু তত্ত্বের উদ্ভব ঘটিয়েছিল। তবে তাদের সকল তত্ত্ব যে সঠিক হবে সে ব্যাপারে কোনও নিশ্চয়তা নেই। নিবিরু নামের কল্পিত সেই গ্রহের সঙ্গে পৃথিবীর সাক্ষাৎ হওয়ার সম্ভাবনাও নাকচ করে দিয়েছে নাসা। নাসার এস্ট্রোবায়োলজির সিনিয়র সায়েন্টিস্ট ডেভিড মরিসন বলেছেন, ‘সুমেরীয়রা যে তত্ত্বের কথা বলেছে এ ধরনের কোনও কিছুর অস্তিত্বই নেই, সম্পূর্ণটাই কল্পনা নির্ভর। ফলে এই বিষয়ে চিন্তিত হওয়ার কিছু নেই।’
(৩) বিজ্ঞানীদের ধারনা অনুযায়ী ২০১২ সালে সানস্ট্রম ও সূর্য ঝড় পৃথিবী ধ্বংসের কারণ হবে। তাদের মতে ২০১২ সালে সূর্যের সবচেয়ে বেশি পরিমাণ এনার্জি তৈরি হবে, যার নাম ‘সোলার ম্যাক্সিমাম’। এই সৌরঝড়ের ভয়ংকর রেডিয়েশন এবং এনার্জি নির্গমনের ফলে ভূপৃষ্ঠে বা মহাকাশে যোগাযোগ ব্যবস্থা ও অন্যান্য ক্ষেত্রে নানা সমস্যা দেখা দিবে। ফলে বেড়ে যেতে পারে মানুষের অসুখ-বিসুখ, দুর্ঘটনা ও ভয়াবহ সব প্রাকৃতিক দুর্যোগ। ফলে পৃথিবী এগিয়ে যাবে চূড়ান্ত পরিণতির দিকে। অবশ্য নাসার বিজ্ঞানীরা এ বিষয়ে তাদের মতামত ব্যক্ত করেছেন। তারা বলেছেন ‘সোলার ম্যাক্সিমাম’ এর প্রভাবে ২০১২ সালটি হবে বিশ্বব্যাপী গরম বছর। এর প্রভাবে বিশ্বব্যাপী মানুষের মাঝে অসুখ-বিসুখ বেড়ে যেতে পারে, স্যাটেলাইট সিগনালে সমস্যার সৃষ্টি হতে পারে এমনকি বিশ্বব্যাপী প্রাকৃতিক দুর্যোগের সংখ্যা বৃদ্ধি পেতে পারে তবে তাতে পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যাওয়ার মতো ঘটনা ঘটবে না। যারা এমন ধারণা নির্ভর গুজব পৃথিবীর মানুষের মাঝে প্রচার করেছে তারা এটা নিয়ে বাণিজ্য করার প্রচেষ্টায় লিপ্ত রয়েছে। বিজ্ঞানী মরিসন বলেছেন, এ বছর সোলার ফ্লেয়ার একটু বেশি হবে। তবে তাতে পৃথিবী ধ্বংস নয়, বড়জোর সমস্যা হতে পারে স্যাটেলাইট যোগাযোগের ক্ষেত্রে।
(৪) ২০১২ সালে পৃথিবী ধ্বংসের আরেকটি প্রধান যে কারণ দাড় করানো হয়েছে সেটি হচ্ছে ‘লার্জ হ্যাড্রন কোলাইডার’। পৃথিবীর জন্ম রহস্য পরীক্ষা করার জন্য সুইজারল্যান্ডের জেনেভায় মাটির নিচে তৈরি করা হয়েছে মানুষের তৈরি সবচেয়ে বড় যন্ত্র লার্জ হ্যাড্রন কোলাইডার। এই পরীক্ষাটি আগে একবার করে বিজ্ঞানীরা ব্যর্থ হয়েছেন। তবে তারা এবার তথা ২০১২ সালে এই পরীক্ষাটি আবার চালানোর জন্য প্রস্তুতি নিয়েছে। এবার যে পরীক্ষাটি সফল হবে তার কোনও নিশ্চয়তা নেই। এটি যদি ব্যর্থ হয় বা কোনও প্রকার বিস্ফোরণ ঘটে তবে এর প্রভাবে ও এর রাসায়নিক পদার্থ ছড়িয়ে পড়ার ফলে বিশ্বব্যাপী মারাত্মক ধ্বংস যজ্ঞের সৃষ্টি হতে পারে। বিজ্ঞানীদের ধারনা এই পরীক্ষায় যদি কোনও দুর্ঘটনা ঘটে তবে পৃথিবীর একটি বিরাট অংশ ধ্বংস হয়ে যাবে। বিজ্ঞানীরা বলেছেন এটি হতে পারে পৃথিবীর জন্য একটি ভয়াবহ অবস্থা। অবশ্য আমরা নিজেরাই যদি নিজেদের বিপদ সৃষ্টি করি তবে তার জন্য নিশ্চয়ই ২০১২ সালেকে বা অন্য কোনও কারণকে দায়ী করলে চলবে না।
(৫) ২০১২ সালে পৃথিবী ধ্বংস হওয়ার পিছনে আরও যে কারণটি দেখানো হয়েছে সেটি হচ্ছে আমেরিকার ইয়েলোস্টোন ভলকানো আগ্নেয়গিরির বিস্ফোরণ। মোটামুটি প্রতি ৬,৫০,০০০ বছর পর ভয়ংকর অগ্ন্যুৎপাত হয় এই আগ্নেয়গিরি থেকে। গবেষণা অনুসারে বলা হয়েছে ২০১২ সালে আবার ভয়ংকর বিস্ফোরণ ঘটবে ইয়োলোস্টোনে এবং তাতেই ধ্বংস হবে পৃথিবী। পৃথিবী ধ্বংসের এই মতবাদটির উত্তরে অন্য বিজ্ঞানীরা বলেছেন ধারনা করা হয় প্রতি ৬,৫০,০০০ বছর পর পর ভয়ংকর অগ্ন্যুৎপাত হয় এই আগ্নেয়গিরি থেকে তবে এবারও যে সেই একই ক্ষণ গণনা করে একইভাবে ২০১২ সালে আবার আগ্নেয়গিরির বিস্ফোরণ ঘটবে এবং তাতেই পৃথিবী ধ্বংস হবে এ ধরনের মতবাদের কোনও ভিত্তি নেই। আশার কথা এই যে, এখনও পর্যন্ত এই আগ্নেয়গিরি থেকে ২০১২ সালে অগ্নুৎপাতের কোনও আশংকা দেখা যায় নি। ফলে এটিও প্রমাণিত হতে যাচ্ছে একটি গুজবে।
(৬) ভাল-মন্দের শেষ যুদ্ধ হিসেবে একটি ভয়াবহ পরিণতির কথা বলা হয়েছে পবিত্র বাইবেলে। আর তা ঘটার সময় হিসেবে ২০১২ সালের দিকে ইঙ্গিত করা হয়েছে। তবে ধর্মবেত্তাদের মত এই যে, এমন একটি পরিণতির কথা বলা হয়েছে তবে সেটি যে ২০১২ সালেই হবে সেটির কোনও প্রমাণ নেই। কারণ পবিত্র বাইবেলের ইঙ্গিত হিসেবে অনেকে ২০১২ সালকে বেছে নিয়েছে তবে সেটি অবশ্যই ২০১২ সাল না হয়ে অন্য কোনও সময়ও হতে পারে। এছাড়া মহাগ্রন্থ আল কুরআন ও আল হাদিসের বর্ণনা অনুসারে পৃথিবী ধ্বংস বা কেয়ামতের আগে বেশ কয়েকটি আলামতের কথা বর্ণনা করা হয়েছে। যার মধ্যে কিছু আলামত আছে ছোট এবং কয়েকটি আছে বড়। ছোট আলামতগুলো ইতোমধ্যে সম্পন্ন হলেও বড় আলামত গুলো এখনও দেখা যায়নি। হাদীসের বর্ণনা অনুসারে কিয়ামত সংঘটিত হবে পৃথিবীতে এই বড় আলামতগুলো সংঘটিত হওয়ার পর। পৃথিবীতে কিয়ামতের এই বড় আলামতগুলো এখনও দেখা যায়নি ফলে নিশ্চিন্তে বলা যায় এখনও পৃথিবী ধ্বংসের সময় আসেনি।
ইসলামের দৃষ্টিতে: প্রত্যেক মুসলমানকে মনে প্রাণে বিশ্বাস রাখতে হবে যে, মহান আল্লাহ রব্বুল আলামিন এই পৃথিবী সৃষ্টি করেছেন এবং একদিন তিনি আবার এই পৃথিবীর ধ্বংস সাধন করবেন। যে দিনটিতে পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যাবে সেই দিনটিকে বলা হয় কিয়ামতের দিন। এখন প্রশ্ন হচ্ছে ২০১২ সালের ২১ ডিসেম্বর তারিখ কিয়ামত সংঘটিত হবে কিনা ! কিয়ামত সংঘটিত হওয়ার পূর্ব লক্ষণ হিসেবে বেশ কিছু ছোট ও বড় চিহ্নের কথা মোহাম্মদ (সাঃ) হাদিসে উল্লেখ করেছেন। ছোট চিহ্নগুলো পৃথিবীতে দেখা গেলেও বড় চিহ্ন গুলো এখনও দেখা যায়নি। বড় চিহ্নগুলোর মধ্যে রয়েছে ইয়াজুজ-মাজুজ, দুমাতুল জান্দাল, দাজ্জাল, ইমাম মাহদী, ঈসা (আঃ) এর পৃথিবীতে আগমন প্রভৃতি। কিয়ামতের এই বড় আলামতগুলো এখনও দেখা যায়নি। সুতরাং ২১ ডিসেম্বর তারিখে কিয়ামত হওয়ার কোনও আশংকা নেই। অনেকে বলতে পারেন ২১ ডিসেম্বর তারিখের আগে হয়তো এই আলামতগুলো দেখা হয়ে যাবে। এর উত্তরে বলা যায়, হাদিসে এসেছে ইমাম মাহদী পৃথিবীতে এসে প্রায় ৭/৯ বছর অবস্থান করবেন, দাজ্জাল পৃথিবীতে দীর্ঘদিন ফেতনা সৃষ্টি করবে, ইমাম মাহদীর পরে ঈসা (আঃ) পৃথিবীতে আগমন করবেন। তাই যদি হয় তবে ২১ ডিসেম্বর কেয়ামত হওয়া অসম্ভব। হাদিসে এসেছে মোহাম্মদ (সাঃ) বলেছেন কিয়ামত কবে হবে এ বিষয়ে আল্লাহ ছাড়া আর কেউ জানে না। এমনকি তার ফেরেশতা ও নবী-রাসুলেরাও জানেন না এবং কোনও দিন জানতেও পারবেন না। তিনি আরও বলেছেন পূর্বে জানা তো দূরের কথা যেদিন কিয়ামত আরম্ভ হবে সেদিনও মানুষেরা জানতে পারবে না যে আজ কেয়ামত হবে। ঈস্রাফিল (আঃ) এর ফুঁৎকারে যখন কিয়ামত শুরু হবে তখন মানুষের চারদিক ছুটাছুটি করবে আর বলবে আজ পৃথিবীর কী হয়েছে? সুতরাং ২১ তারিখ কিয়ামত হওয়ার বিষয়টি সম্পূর্ণ মিথ্যা।
এই সকল ভ্রান্ত মতবাদ মুসলমানদের ঈমান-হারা করে দিতে পারে। এই বিষয়ে সকল মুসলমানদের বিশ্বাস থাকতে হবে যে, কিয়ামত কবে হবে সেটা শুধুমাত্র এক আল্লাহ জানেন। কোনও মুসলমান যদি মানুষের দেয়া কোনও দিন তারিখকে বিশ্বাস করে থাকেন তবে তিনি ঈমান-হারা হয়ে মুশরিক হয়ে যাবেন।
সর্বশেষে বলা যায়, পৃথিবী ধ্বংসের তারিখ এর আগে কয়েকবার ঘোষণা করা হয়েছিল কিন্তু প্রতিবারই মানুষের এই ভবিষ্যৎ বাণী মিথ্যাই পরিণত হয়েছে। মিথ্যাচার, বাণিজ্য বা সতর্ক করা যে কারণেই হোক না কেন মায়া ক্যালেন্ডার সহ বেশ কিছু সূত্রকে উপাদান বানিয়ে আবারও ঘোষণা করা হয়েছে পৃথিবী ধ্বংসের তারিখ। তবে বিশেষজ্ঞ মহল ও বিজ্ঞানীরা ইতোমধ্যে ২০১২ সালে ডিসেম্বরের ২১ তারিখের পৃথিবী ধ্বংসের মতবাদকে মিথ্যা হিসেবে প্রমাণ করেছেন। তাই পরিশেষে এটাই বলা যায়, ২০১২ সালে পৃথিবী ধ্বংসের খবর মিথ্যা ও গুজব। তবে একটি আশংকা চিন্তার কারণ হয়ে থাকছে। আর সেটি হচ্ছে লার্জ হ্যাড্রন কোলাইডার পরীক্ষা। এই পরীক্ষাটি যদি এই বছর চালানো হয় এবং সেটি যদি কোনও দুর্ঘটনার সৃষ্টি করে তবে নিজেদের বিপদ নিজেরা নিয়ে এসে সেটির দোষ ২০১২ সাল বা অন্য কারও দেওয়া উচিৎ হবে না।
(copy)
কেন ২১ ডিসেম্বর ২০১২?
বর্তমান মেক্সিকোর দক্ষিণাঞ্চল, ক্যালিফোর্নিয়া, বেলিজ এবং হন্ডুরাস ও এল সালভাদরের কিছু অংশজুড়ে বিস্তৃতি ছিল মায়া সভ্যতা। জ্যোর্তিবিদ্যা, সংস্কৃতিসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে বেশ উন্নত ছিল। মায়ান যুগের শুরু আগস্ট ১১, ৩১১৪ খ্রি. পূ.। মায়া সভ্যতার দিনপঞ্জি অনুযায়ী এক লাখ ৪৪ হাজার দিনে (প্রায় ৪০০ বছর) এক বাকতিউন। ১৩ বাকতিউনে হয় পাঁচ হাজার ১২৫ বছর। এই সময় শেষ হবে ২১ ডিসেম্বর ২০১২। কিন্তু এরপর তাদের দিনপঞ্জিতে আর কোনো দিনের অস্তিত্ব নেই। তাই এ দিনটি ঘিরে যত সব কল্পনা-জল্পনা। কেউ কেউ বলছেন, হয়তো পৃথিবীর সঙ্গে কোনো গ্রহাণুর সংঘর্ষ হবে। মায়া সভ্যতার গবেষক মার্ক ভন স্টোনের মতে, মায়া ও অ্যাজটেক—কোনো সভ্যতাতে সরাসরি পৃথিবী ধ্বংসের কথা বলা হয়নি।
বিজ্ঞান কী বলে?
নাসা বলছে, জল্পনা-কল্পনার শুরু ২০০৩ সালে। সুমেরিয়ানদের কল্পিত নিবিরু নামের গ্রহটি ওই বছর মে মাসে পৃথিবীতে আঘাত হানবে। এর ফলে ধ্বংস হবে পৃথিবী। কিন্তু তখন কিছুই হয়নি। এর পরই শুরু হয় মায়া সভ্যতার দিনপঞ্জি নিয়ে কল্পনা। ২০১২ সালের ২১ ডিসেম্বরের পর ওই দিনপঞ্জিতে কোনো দিন নেই বলে অনেকেই বলতে শুরু করেন, ওই দিন নিবিরু আঘাত হানবে। কিন্তু এমন গ্রহের কোনো অস্তিত্বই নেই।
ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক নিউজ, হাফপোস্ট হোম, নাসা।
পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যাবে- এটি একটি বহু পুরনো পাবলিক ক্রেজ। এবং এই ক্রেজই ছিল ক্রসেডের অন্যতম একটি কারণ। মধ্যযুগে খ্রিস্টীয় জগতে বিশ্বাস করা হত যে ১০০০ সালে পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যাবে। এই বিশ্বাসকে Millenarianism বা millenarism বলে। Millenarism is the belief by a religious, social, or political group or movement in a coming major transformation of society, after which all things will be changed, based on a one-thousand-year cycle.দশম শতক ঘনিয়ে এলে ইউরোপের খ্রিস্টানরা পবিত্র জেরুজালেম জীবনের অন্তিম মুহূর্ত অতিবাহিত করতে চাইল । নগরটি তখন মুসলিম মুরদের দখলে। তারা খ্রিস্টানদের বাধা দিলে লড়াই (ক্রসেড) শুরু হয়ে যায়।
অনেকের ধারণা ২০১২ সালে পৃথিবীতে নিবিরু গ্রহটি আছড়ে পড়বে।
অনেকেরই ধারণা ২০১২ সালে পৃথিবীতে নিবিরু গ্রহ আছড়ে পড়বে। নিবিরু গ্রহটি নাকি প্রাচীন সুমেরিয়দের আবিস্কার। সেটিই নাকি পৃথিবীর দিকে ধেয়ে আসছে। লেখক জাকারিয়া সিটচিন মেসোপটেমিয়ার পটভূমিতে কল্পকাহিনীর লেখেন। তার লেখায় রয়েছে নিবিরু গ্রহটি ৩৬ হাজার বছরে একবার সূর্যকে প্রদক্ষিণ করে। এই মনগড়া তথ্যের ওপর ভিত্তি করে স্বঘোষিত সাইকি ন্যান্সি লেইডার দাবি করে বসলেন তার সঙ্গে ভিন গ্রহের বুদ্ধিমান প্রাণির যোগাযোগ আছে। এবং নিবিরু গ্রহটি পৃথিবীতে আছড়ে পড়বে। ন্যান্সি লেইডার সংঘর্ষের তারিখ ২০০৩ সালের মে মাস নির্ধারণ করেন। ২০০৩ সালে যখন কিছুই ঘটল না, তখন তিনি তারিখটি আবার ২০১২ সালের ডিসেম্বর মাসে তারিখটি পুর্ণনির্ধারণ করেন। এর কারণ কি? মায়া সভ্যতার প্রতি মানুষের রহস্যময় আকর্ষণ।
দক্ষিণ আমেরিকার মায়া সভ্যতার মানচিত্র। মায়া সভ্যতার সময়কাল ২৫০ থেকে ৯০০ খ্রিস্টাব্দ। সভ্যতাটির ব্যাপ্তি ছিল দক্ষিণ মেক্সিকো, গুয়েতেমালা, বেলিজ, এল সালভাদর এবং হন্ডুরাসের কিছু অংশ। প্রত্নতাত্ত্বিকগণ মায়াসংস্কৃতির বিভিন্ন দিক সম্বন্ধে গবেষনা করেছেন । এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল মায়াদের লিখনপদ্ধতি আবিস্কার করা।
মায়ারা প্রধানত দুটি ক্যালেনডার ব্যবহার করত। একটি হল- ‘দীর্ঘ গণনা’ বা ‘লং কাউন্ট’। এটি অতীত এবং ভবিষ্যৎ ঘটনা সর্ম্পকিত। অন্য ক্যালেনডারটি ছোট, যার ব্যাপ্তি ৫২ বছর। এটি ‘ক্যালেনডার রাউন্ড’ নামে পরিচিত। এর সময়সীমা একজন ব্যাক্তির জীবৎকাল। লং কাউন্ট- এর সূচনা ৩১১৪ খ্রিস্টপূর্ব। এবং এটি ৫১২৬ বছর পর অর্থাৎ শেষ হয়েছে ২০১২ খ্রিস্টাব্দের ২১ ডিসেম্বর। এই কারণেই রহস্যের সৃষ্টি হয়েছে।
মায়া দীর্ঘ গণনা বা লং কাউন্ট ক্যালেনডার। মায়াদের ক্যালেনডার সর্ম্পকে নাসার বিজ্ঞানী ড. ডেভিড মরিসন মন্তব্য করেছেন:The Mayan astronomers were clever, and they developed a very complex calendar. Ancient calendars are interesting to historians, but of course they cannot match the ability we have today to keep track of time, or the precision of the calendars currently in use.
স্বাভাবিক কারণেই ঐতিহাসিকরা মায়া ক্যালেনডার- এর সঙ্গে গ্রেগরিয়ান ক্যালেনডার- এর সমন্বয় সাধন বা 'কোরিলেট' করেছেন । নইলে মায়া ইতিহাস মায়াদের জগতের বাইরে বোধগম্য হবে না। সমস্যার মূল এটিই। প্রত্ন
তাত্ত্বিকগন মায়া ইতিহাসের বিভিন্ন পর্যায় বর্ননা করার সময় মায়া ক্যালেনডার কে গ্রেগরিয়ান ক্যালেনডার এ রূপান্তরিত করতে GMT কোরিলেশন পদ্ধতি অনুসরণ করেছেন। GMT হল তিনজন প্রত্নতত্ত্ববিদের নামের আদ্যক্ষর। এরা হলেন জোসেফ গুডম্যান, জুয়ান মার্টিনেজ -হার্নান্ডেজ এবং জে. এরিক এস থম্পসন। তবে GMT -র নির্ভরযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। এদের মধ্যে ইউনিভার্সিটি অভ ক্যালিফোর্নিয়ার (সান্তা বারবারা) অধ্যাপক জেরাল্ডো আলডানা অন্যতম। তিনি GMT -র যথার্থতা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন। যেমন একজন ইউরোপীয় গবেষক লিখেছেন: গুয়েতেমালার মায়া রাজা চাক এক- এর উদয়ের সময় যুদ্ধ শেষ করেন। এত দিন ধারণা ছিল চাক এক হল শুক্র গ্রহ। অধ্যাপক আলডানা ধারণা করছেন চাক এক হল উল্কা। আমরা জানি, মায়ারা জ্যোতিবিজ্ঞান চর্চা করত । চাঁদের কলা, গ্রহন এমন কী শুক্র গ্রহের আন্দোলন অবধি তারা অবগত ছিল। শুক্র গ্রহের আবর্তনের সঙ্গে মায়া ক্যালেনডার সর্ম্পকিত ।
মায়াদের নিয়ে মানুষের অনেক রহস্যময়তা ছড়িয়েছে। বলা হয় মায়া সভ্যতার উত্থান নাকি আকস্মিক এবং ১২০০ শতকে সভ্যতাটি আকস্মিকভাবে 'ভ্যানিশ' হয়ে যায়। আসলে মায়া সভ্যতার পতনের অন্যতম কারণ ছিল অনাবৃষ্টি এবং বনভূমি উজার হয়ে যাওয়া।
এভাবে GMT কোরিলেশন পদ্ধতি অনেকবারই ভুল প্রমাণিত হয়েছে। অথচ এতসব অসংগতির পরও ২০১২ সালের ২১ ডিসেম্বরই যে পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে সে ব্যাপারে অনেকেই নিশ্চিত। তার কারণ কি? স্বার্থান্বেষী মহল টিকিয়ে রাখছে অর্থনৈতিক স্বার্থেই। এ প্রসঙ্গে ডিসকভারি নিউজ এর আয়ান ও নিল লিখেছেন: After all, proving that the world isn't going to end is bad for business if you have a doomsday book to sell.আর নাসার বিজ্ঞানী ড. ডেভিড মরিসন বলছেন,Calendars exist for keeping track of the passage of time, not for predicting the future. The main point, however, is that calendars, whether contemporary or ancient, cannot predict the future of our planet or warn of things to happen on a specific date such as 2012. I note that my desk calendar ends much sooner, on December 31, 2009, but I do not interpret this as a prediction of Armageddon. It is just the beginning of a new year.
মায়াদের টরটুগুয়েরো নগরে ইংরেজি টি-আকারের ৬নং স্মৃতিস্তম্ভ
যে নিয়ে তারিখটি নিয়ে পৃথিবীজুড়ে এত জল্পনাকল্পনা চলছে সেটি কোথায় রয়েছে? ৭০০ শতকের মায়াদের টরটুগুয়েরো নগরে একটি স্মৃতিস্তম্ভ আবিস্কৃত হয়েছে । ইংরেজি টি-আকারের ৬নং মনুমেন্ট নামে পরিচিত। এর ওপর খোদিত আছে 'দীর্ঘ গণনার' একটি তারিখ (৯.১১.১৬.৮.১৮) । এটি আসলে ভবন নিমার্ণের তারিখ। এরপর মায়ান ভাষায় লেখা: ‘জুহটজুম উ ১৩ বাখতুন ৪ আজাও ৩ কানকিন উতুম।’ এই লাইনটি ১৩ বাখতুন (ডিসেম্বর ২১, ২০১২)- এর পরের ভবিষ্যতের কোনও ঘটনাকে নির্দেশ করছে। এর পর লেখা রয়েছে তখন বোলোন য়ুকটে (দেবতাগন) আবিভূর্ত হবেন। লিপিটি ভগ্ন বলে আর কিছু বোঝা যায়নি। তবে পৃথিবী যে ২০১২ সালের ২১ ডিসেম্বর ধ্বংস হয়ে যাবে সেরকম ভবিষ্যৎবাণী মায়ারা করেনি।
না, শায়মা আপা, ২০১২ সালের ২১ ডিসেম্বর পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে না।
তবে পৃথিবী ধ্বংস হবে ঠিকই যখন ৪ বিলিয়ন বছর পর সূর্যের ভিতরে হাইড্রোজেন নিঃশেষ হয়ে যাবে। ভারী উপাদান জ্বালাতে জ্বালাতে বেলুনের মতো ফুলে যাবে সূর্যটা । আর সৌরজগতের সব গ্রহকে গিলে খাবে।তখনই পৃথিবী পুড়ে ছাই হয়ে যাবে। সেসবের তো অনেক দেরি। কাজেই আগামী বছর কিছুই হচ্ছে না। যদিও অনেকে বিশ্বাস করছে এবং ভয় পাচ্ছে। আগেও একবার বলেছি, এর পিছনে রয়েছে অর্থনৈতিক স্বার্থ। একজন লেখক এ বিষয়ে মন্তব্য করেছেন: Doomsayers with YouTube accounts and producers with multi-million dollar budgets are profiting from tales of doomsday.
অনেকেরই অলীক বিশ্বাস যে ২০১২ সালের ২১ ডিসেম্বর নিউ ইর্য়কের পিস অভ লিবার্টি ধ্বংস হয়ে যাবে। বেশির ভাগ মানুষই আসলে তলিয়ে দেখে না। তারা হুজুগে মাতে। হয়তো বিশ্বব্যাপী বিপর্যয়ের ভাবনাটি তাদের নিরানন্দ জীবনে রোমাঞ্চকর অনুভূতি এনে দেয় ...
পৃথিবী ধ্বংসের বিষয়টি ধর্মীয় বোধে পর্যবেশিত হয়েছে
অনেকের মধ্যে Millenarianism বোধটিও প্রবল ...
বিশ্বের দেশে দেশে সাধারণ মানুষের মাঝে এই নিয়ে শুরু হয়েছে জল্পনা, কল্পনা ও চিন্তা-ভাবনা। সত্যিই কি ধ্বংস হয়ে যাবে পৃথিবী? বিজ্ঞানীদের ধারনা আবার অনেক বিজ্ঞানীর অগাধ বিশ্বাস যে, এই ২০১২ সালের ডিসেম্বরের ২১ তারিখই ধ্বংস হয়ে যাবে পৃথিবী। তাদের ধারনা অনুযায়ী পৃথিবী ধ্বংস হবে প্রাকৃতিক ধ্বংসযজ্ঞে বা মানুষের নিজেদের ভুলে। পৃথিবী ধ্বংসের তারিখ ঘোষণা নতুন নয়, এর আগে ২০০০ সালের ৫ মে তারিখকে বিজ্ঞানীরা পৃথিবী ধ্বংসের তারিখ হিসেবে ঘোষণা করেছিল। তবে সেদিন পৃথিবী ধ্বংস হওয়া তো দূরের কথা সেদিন পৃথিবীর কোথাও সামান্যতম দুর্ঘটনাও ঘটেনি। তবে এবার তাদের যুক্তি আরও প্রবল। আর এই বিশ্বাসকে ছড়ানো হচ্ছে বিশ্বব্যাপী মানুষের মাঝে। বিশ্বাসকে মানুষের মাঝে জোরালো করার জন্য ইতোমধ্যে 2012 নামে একটি সিনেমা তৈরি করা হয়েছে। অনলাইনের অনেক ওয়েব সাইট আবার ২১ ডিসেম্বরের দিনকে কেন্দ্র করে ক্ষণ গণনা শুরু করেছে। তাহলে কি ২০১২ সালই হবে পৃথিবীর শেষ বছর! আসুন আমরা একটু গভীরে গিয়ে রহস্যটা বোঝার চেষ্টা করি।
২০১২ সালে পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যাবে এই কথাটা বিশ্বব্যাপী প্রচার করা হয়েছে মূলত ছয়টি যুক্তিকে কেন্দ্র করে। যেগুলো হলো, মায়াদের ক্যালেন্ডার, সুমেরীয়দের তত্ত্ব, সূর্যঝড়, সুইজারল্যান্ডের লার্জ হ্যাড্রন কোলাইডার, ভয়ঙ্কর অগ্নুৎপাত ও পবিত্র বাইবেলের ঘোষণা। আসুন আমরা প্রথমে পৃথিবী ধ্বংসের যুক্তিগুলোর সাথে পরিচিত হয়ে নেই।
(১) মায়াদের ক্যালেন্ডার: ২০১২ সালে পৃথিবী ধ্বংস হওয়ার প্রধান যে যুক্তি সেটি হচ্ছে মায়াদের বর্ষপঞ্জি। সভ্যতার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নিদর্শন ছিল ২০০০ বছর আগেকার মায়া সভ্যতা। ২৫০ থেকে ৯০০ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে মেক্সিকো ও মধ্য আমেরিকার বিশাল অঞ্চল জুড়ে বিকাশ লাভ করেছিল এই মায়া সভ্যতা। সেই সময় মায়ারা তৈরি করেছিল এক রহস্যময় ক্যালেন্ডার। মায়াদের সময় বিশ্বজুড়ে স্থাপত্য, সংস্কৃতি আর বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে অগ্রগতি ছিল নজিরবিহীন। প্রাচীন মিথ, জ্যোতিষশাস্ত্র কিংবা প্রাচীন বুদ্ধিমান সভ্যতার ওপর যাদের আস্থা চরম তাদের প্রথম পছন্দ মায়া সভ্যতা। এই সভ্যতার আরও অনেক নিদর্শনের মধ্যে রয়েছে এর কয়েক হাজার বছর ধরে চলা বর্ষপঞ্জি। দক্ষিণ আমেরিকায় ইউরোপীয় উপনিবেশ স্থাপনের আগে এই বর্ষপঞ্জি অনুসরণ করত এ অঞ্চলের মানুষ। পরে গ্রেগরিয়ান বর্ষপঞ্জি চালু হয়ে যায়। সেই বিখ্যাত মেসো আমেরিকান লং কাউন্ট ক্যালেন্ডার পাঁচ হাজার ১২৫ বছরের বৃত্ত শেষ করছে এ বছরের ২১ ডিসেম্বর। সবচেয়ে বড় ভয়ংকর ব্যাপার হলো, মায়া পঞ্জিকাতে আজ পর্যন্ত যত ভবিষ্যদ্বাণী করা হয়েছে তার প্রতিটিই কালের আবর্তে সত্য ঘটনায় পরিণত হয়েছে। আর এ কারণেই পৃথিবী ধ্বংসের আশংকা নিয়ে এত বেশী আলোচনা হচ্ছে। অধিকাংশ প্রাচীন সভ্যতায় উল্লেখ থাকে যে, অলৌকিক ক্ষমতাসম্পন্ন কেউ একজন দূর থেকে আমাদের নিয়ন্ত্রণ করছেন। জীবনের প্রতিটি খুঁটিনাটি ঘটনা সেই একজনের বিশাল বড় এক ঐশ্বরিক প্ল্যানের অংশ বিশেষ। আর প্রাচীন সভ্যতায় উল্লেখিত এই ঐশ্বরিক প্ল্যান বুঝতে পারার জন্য পৃথিবীর একমাত্র উপায় এই মায়ান পঞ্জিকা। কিন্তু কী আছে মায়ান ক্যালেন্ডারে ? জিনিসটাই বা কি? পুরাতন সেই মায়ান সভ্যতা ইতিহাসের এক অনুপম সৃষ্টি। সময় এবং সৃষ্টির সুন্দর বিন্যাস সম্পর্কে মায়ানরা অনেক আগেই অবগত ছিলেন। তাদের ছিল ভবিষ্যৎ জানার নান্দনিক ক্ষমতা। মায়ানরা আগে থেকেই জানতো যে চাঁদ, শুক্র এবং অন্য গ্রহ গুলো মহাবিশ্বে চকরাকারে ঘুরছে। সেই সময়েই তারা নিখুঁতভাবে সময় গণনা করতে পারত। তাদের একটি পঞ্জিকা ছিল যাতে সৌর বছরের প্রতিটি মিনিটের নিখুঁত বর্ণনা ছিল। মায়ানরা মনে করত প্রতিটি জিনিসের উপর সময়ের প্রভাব রয়েছে এবং প্রতিটি জিনিস একেক সময় একেকটি অবস্থানে বিরাজ করছে। মায়ানদের কাছে মহাকাশের উপর ২২টি ভিন্ন ভিন্ন পঞ্জিকা ছিল। এর মধ্যে কোন কোনও পঞ্জিকা এখন থেকে ১০ মিলিয়ন বছর আগের। আর সেগুলো এত দুর্বোধ্য যে তা বুঝতে চাইলে হিসাব-নিকাশ করার জন্য সঙ্গে অবশ্যই একজন করে এস্ট্রোনমার, এস্ট্রোলজার, জিওলজিস্ট এবং ম্যাথমেটিশিয়ান থাকতে হবে। অধিকাংশ আর্কিওলজিস্ট মনে করেন মায়ানরা খ্রিস্ট জন্মের প্রায় ৩ হাজার ১১৪ বছর আগে থেকে সময় গণনা করা শুরু করেছে। আমাদের বর্তমান পঞ্জিকা মতে খ্রিস্টের জন্মের বছরের জানুয়ারি মাস থেকে প্রথম বছর গণনা করা হয়। আর মায়ান ক্যালেন্ডার অনুযায়ী এই বছরটাকে হিসাব করা হয় শূন্য বছর। এই সময়টাকে লেখা হয় এভাবে :০-০-০-০-০। একটা নতুন চক্র শুরু হওয়ার আগের ১৩ চক্রে ৩৯৪ বছর শেষ হয়ে যাবে। আর নতুন চক্রটি শুরু হবে ২০১২ সালের। সবচেয়ে আশংকার ব্যাপার হলো ২০১২ সালের ২১ ডিসেম্বরের পর থেকে মায়ান পঞ্জিকাতে আর কোনও দিনের উল্লেখ নেই। তাই এই দিনটিকে মনে করা হচ্ছে পৃথিবীর সর্বশেষ দিন। আর একটি বিষয় হলো আজ পর্যন্ত মায়ান পঞ্জিকাতে যা-ই ভবিষ্যদ্বাণী করা হয়েছে, তার প্রতিটি কথা অক্ষরে অক্ষরে প্রতিফলিত হয়েছে। আজকের বিজ্ঞানের চরম উৎকর্ষতা থেকে শুরু করে বিজ্ঞানের সব গুরুত্বপূর্ণ উত্থানের উল্লেখ মায়ানদের ক্যালেন্ডারে আগে থেকেই ছিল। তাই বিশ্বের বাঘা বিজ্ঞানীরাও ২০১২ সালের ২১ ডিসেম্বরে পর থেকে কী ঘটতে পারে তাই নিয়ে দুশ্চিন্তায় আছেন। বর্তমানে মানুষের চিন্তা-চেতনা এবং ধ্যান-ধারণায় অনেক পরিবর্তন এসেছে। সময় এবং বিজ্ঞান সম্পর্কিত জ্ঞানের বিষয়ে মধ্য আমেরিকার মায়ান সভ্যতাই সবচেয়ে বেশি এগিয়ে ছিল এবং আছে। সমগ্র পৃথিবীর মধ্যে তাদের পঞ্জিকাই সবচেয়ে বেশি নিখুঁত। আজ পর্যন্ত কেউ এর কোনও খুঁত খুঁজে পায়নি।
(২) সুমেরীয়দের তত্ত্ব: ২০১২ সালে পৃথিবী ধ্বংসের পিছনে কারণ হিসেবে দেখানো হচ্ছে সুমেরীয়দের আবিষ্কৃত গ্রহ নিবিরু আর পৃথিবীর কক্ষপথ একই রেখায় চলে আসার তত্ত্ব। বলা হয়েছে এ দুই গ্রহের মুখোমুখি সংঘর্ষ হবে আবার যদি পুরোপুরি নাও হয় তবে পৃথিবীর একটা অংশ ছুঁয়ে যাবে। তা ছাড়া নিবিরু পৃথিবীর কাছাকাছি চলে আসার ফলে দুই গ্রহের মাধ্যাকর্ষণ শক্তির ঘাত-প্রতিঘাত পৃথিবীর গতিতেও এনে দেবে পরিবর্তন। কেউ কেউ প্রমাণ হিসেবে নাসার একটি পূর্বাভাসকেও ব্যবহার করছে। যেখানে বলা হচ্ছে, ২০১২ সালে সূর্য তুলনামূলক ভাবে বেশি উত্তপ্ত থাকবে। এ সময় ‘সোলার ফ্লেয়ার’ বা সূর্যের মধ্যে বিস্ফোরণের পরিমাণ বেড়ে যাবে। পৃথিবী ধ্বংসের এই ধারনাকে আরও উসকে দিয়েছে ২০০৯ সালে মুক্তি পাওয়া 2012 নামের একটি ছবি। যেখানে দেখানো হয়েছে, সূর্যের উত্তাপ বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে পৃথিবীর কেন্দ্রের উত্তাপও ভয়ংকর ভাবে বেড়ে যাচ্ছে। এর ফলে গলে যাচ্ছে পৃথিবীর ভূখণ্ড। পৃথিবীতে আর ভূখণ্ড বলে কিছু থাকছে না। পুরো পৃথিবী তলিয়ে যাচ্ছে পানির নিচে।
(৩) সূর্যঝড়: সানস্ট্রম বা সূর্যঝড়কে বিজ্ঞানীরা পৃথিবীর ভবিষ্যতের জন্য একটি ভয়ঙ্করতম হুমকি বলে মনে করছেন। সূর্যের ভেতরে প্রতিনিয়ত নানা ধরনের বিস্ফোরণ থেকে তৈরি হয় এনার্জি। আর সেই এনার্জি থেকে ইলেকট্রন, প্রোটনের মতো নানা পার্টিকল পৃথিবীতে এসে পৌছায় এবং এগুলোর ক্ষতিকর প্রভাব এসে পড়ে পৃথিবীর উপর। সেই সঙ্গে সোলার র্স্ট্রম বা সৌরঝড় তো রয়েছেই। ২০১২ সালে সূর্যের সবচেয়ে বেশি পরিমাণ এনার্জি তৈরি হবে, যার নাম ‘সোলার ম্যাক্সিমাম’। এই সৌরঝড়ের ভয়ংকর রেডিয়েশন এবং এনার্জি নির্গমনের ফলে ভূপৃষ্ঠে বা মহাকাশে যোগাযোগ ব্যবস্থা ও অন্যান্য ক্ষেত্রে নানা সমস্যা দেখে দিবে। বেড়ে যেতে পারে মানুষের অসুখ বিসুখ, দুর্ঘটনা ও ভয়াবহ সব প্রাকৃতিক দুর্যোগ। ফলে পৃথিবী এগিয়ে যাবে চূড়ান্ত পরিণতির দিকে।
(৪) লার্জ হ্যাড্রন কোলাইডার: পৃথিবীর জন্য আরেকটি সম্ভাব্য হুমকি হচ্ছে লার্জ হ্যাড্রন কোলাইডার’। পৃথিবীর জন্মমুহূর্তে পৌঁছাতে সুইজারল্যান্ডের জেনেভায় মাটির নিচে তৈরি করা হয়েছে মানুষের তৈরি সবচেয়ে বড় যন্ত্র লার্জ হ্যাড্রন কোলাইডার। বিগ ব্যাংয়ের সময় মহাবিশ্বের জন্মলগ্নে পৃথিবী কি রকম ছিল তা জানতে ২৭ কি. মি. লম্বা জোড়া পাইপের ভেতর দিয়ে বিজ্ঞানীরা প্রোটনকে কোটি কোটি বার চক্কর খাওয়াবে এখানে। তারপর প্রায় আলোর গতির কাছাকাছি পৌঁছে বিপরীতমুখী প্রোটনের সঙ্গে ভয়ঙ্কর ধাক্কা খেয়ে ভেঙ্গে টুকরো টুকরো হয়ে তৈরি হবে ডট্রিলিয়ন ডিগ্রি (১০০,০০০,০০০,০০০) সেন্টিগ্রেড উত্তাপ। মাল্টিপেক্সড এনালগ সিগন্যাল প্রসেসরে জমা হতে থাকবে অগণিত তথ্য। সেই তথ্য বিশ্লেষণ করে বিজ্ঞানীরা জানবেন পৃথিবী সৃষ্টির রহস্য। এই পরীক্ষাটি আগে একবার চালানো হলেও সেটি ব্যর্থ হয়েছিল। ২০১২ সালে পরিপূর্ণভাবে চালানোর কথা আছে এই পরীক্ষাটি। এটিই হবে বিজ্ঞানের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও ঝুঁকিপূর্ণ পরীক্ষা। কারণ এর ফলে ঘটতে পারে ভয়ংকর দুর্ঘটনা।
(৫) ভয়ঙ্কর অগ্নুৎপাত: পৃথিবীর সবচেয়ে ভয়ংকর আগ্নেয়গিরি হলো আমেরিকার ইয়েলোস্টোন ভলকানো। মোটামুটি প্রতি ৬,৫০,০০০ বছর পর পর ভয়ংকর অগ্ন্যুৎপাত হয় এই আগ্নেয়গিরি থেকে। গবেষণা অনুসারে ২০১২ সালে ভয়ংকর বিস্ফোরণ ঘটবে আবার ইয়োলো স্টোনে। হয়তো সেখান থেকে এমন ভয়াবহ অগ্ন্যুৎপাত হবে যাতে পৃথিবীর সব বায়ু মণ্ডল ঢেকে যাবে এবং ছাইয়ে চাপা পড়ে যাবে সূর্যও। তখন গোটা পৃথিবী অন্ধকারে ঢেকে যাবে। এভাবে কিছু দিন চললেই পৃথিবী থেকে প্রাণের স্পন্দন থেমে যাবে। আবার এই অগ্ন্যুৎপাতের ফলে পৃথিবীর তাপমাত্রা মারাত্মকভাবে বৃদ্ধি পেয়ে পৃথিবীর অন্যান্য আগ্নেয়গিরিগুলো জীবিত হয়ে তৈরি করতে পারে নতুন কোনও বিগ ব্যাং।
(৬) বাইবেলের ঘোষণা: পবিত্র বাইবেলে বলা হয়েছে পৃথিবীতে ভাল-মন্দের লড়াই সার্বজনীন। এবং ভাল-মন্দের চূড়ান্ত বিচার বা লড়াইয়ের একটা শেষ পরিণতি থাকে। আর সেই শেষ পরিণতির সময় হিসেবে ২০১২ সালের দিকে ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছে। ‘The I Ching’ নামের চীনা এক গ্রন্থেও এই বিষয়ের কথাটির উল্লেখ পাওয়া যায়।
এতক্ষণ আমরা পৃথিবী ধ্বংসের কারণগুলোর সাথে পরিচিত হলাম। এই কারণগুলো দ্বারা তাহলে কি আপনার মনে হচ্ছে পৃথিবী সত্যিই ২০১২ সালে ধ্বংস হয়ে যাবে? তাহলে আসুন এবার এর উত্তর খোজা যাক।
(১) মহাপ্রলয়ের এমন ভবিষ্যদ্বাণী অনেক বার করা হয়েছে অতীতে। তখন দেখা যেত অন্ধ বিশ্বাসী মানুষেরা ঘটিবাটি নিয়ে দলে দলে উঠে যেত উঁচু পাহাড়ের গায়ে যাতে মহাপ্রলয় থেকে রক্ষা পেতে পারে। এবারও তেমনিভাবে ছড়ানো হয়েছে তেমনই একটি ভবিষ্যদ্বাণী। যা দ্রুত ছড়িয়ে পড়েছে বিশ্বব্যাপী। এবার গুঞ্জন ছড়ানো হয়েছে যে পৃথিবী ধ্বংসের এই দিনটি হিসাব নিকাশ করে বের করেছে প্রাচীন মায়া সভ্যতার পুরোহিতরা এবং সেটা ভুল হবার নয়। ২০১২ সালের ২১ ডিসেম্বরই যে পৃথিবীর শেষ দিন তার প্রমাণ মায়াদের ক্যালেন্ডার বা বর্ষপঞ্জি, কারণ ঐদিন শেষ হয়ে গেছে তাদের ক্যালেন্ডার। কিন্তু সমস্যা একটাই। প্রাচীন মায়ার পুরোহিতরা কখনও এমন ভবিষ্যদ্বাণী করেনি। বিজ্ঞানও এটা সমর্থন করেনি। মায়া সভ্যতার স্বর্ণযুগ ছিল ২৫০ থেকে ৯শ' খ্রিস্টাব্দ। সে সময়কার জ্ঞান-বিজ্ঞান, শিল্প-সাহিত্য ও স্থাপত্যের অসাধারণ নিদর্শন হিসেবে মায়াদের হাজার হাজার শিল্পকর্ম ও হাইরোগ্লিফ বা চিত্র লেখার অস্তিত্ব আছে। তা থেকে অন্তত এইটুকু জানা যায় যে, পুনর্জন্ম ও পুনঃ সৃষ্টি নিয়ে মায়াদের মধ্যে আচ্ছন্নতা ছিল। কিন্তু ভবিষ্যতের কোন আলামত নিয়ে নয়। মায়াদের লোককাহিনীতে অতীত জগতের বিবরণ আছে। কিন্তু বর্তমান জগত কখন কিভাবে শেষ হয়ে যাবে কিংবা আদৌ হবে কি না সে সম্পর্কিত কোন বিবরণ নেই।
তারপরও মায়া পুরোহিতদের ভবিষ্যদ্বাণী বলে যা বলা হচ্ছে তা একটু খতিয়ে দেখলেই আসল রহস্যটা জানা যাবে। মায়ারা সময়কে মহাপ্রলয়ের দিকে টিক টিক করে এগিয়ে চলা ঘড়ি মাত্র হিসেবে দেখত না বরং অনন্ত চক্রের এক জটিল ব্যবস্থা হিসেবে মনে করত। এসব চক্রের একটি ছিল 'মায়া লং কাউন্ট' যার মেয়াদ ছিল ৫ হাজার বছরেরও বেশি। আমাদের ক্যালেন্ডারে সেই চক্র শুরু হয়েছিল খ্রিস্টপূর্ব ৩১১৪ সালের আগস্ট মাসে এবং তা শেষ হবার কথা ২০১২ সালের ২১ ডিসেম্বর মায়া সংখ্যাতত্ত্ব অনুযায়ী যা ১৩.০.০.০। যেহেতু ২১ ডিসেম্বর মায়া বর্ষপঞ্জির ঐ চক্রের শেষ তাই ঐ দিনটাকে পৃথিবী ধ্বংসের দিন বলে অপব্যাখ্যা করা হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে এমন মনে করার কোন কারণ নেই যে, মায়ারা ভেবেছিল ঐ দিনই পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যাবে। ২১ ডিসেম্বর মায়া ক্যালেন্ডারের একটি চক্রের শেষ হলেও পরের দিন অর্থাৎ ২২ ডিসেম্বর থেকে মায়া বর্ষপঞ্জির নতুন একটি চক্র শুরু হবার কথা। নিউইয়র্কের কোলগেট বিশ্ববিদ্যালয়ের মায়া সভ্যতার বিশেষজ্ঞ ডেভিড স্টুয়ার্ট বলেছেন, মায়ার লম্বা বর্ষপঞ্জি শেষ হয়ে যাচ্ছে ঠিকই, কিন্তু পরের দিন শেষে আবারও মায়ার লম্বা বর্ষপঞ্জির নতুন যাত্রা শুরু হবে, ঠিক যেমন ৩১ ডিসেম্বর শেষে আমরা ঘরের দেয়ালে পুরনো বর্ষপঞ্জি ফেলে দিয়ে নতুন বর্ষপঞ্জি টানিয়ে দেয়। কাজেই ২১ ডিসেম্বর কোনভাবেই শেষ দিন নয়।
তাহলে মহাপ্রলয়ের এই ধারণার উৎপত্তি হলো কিভাবে? মেঙকোর তরতুগুয়েরো নামক জায়গায় একবার মায়া যুগের একটা চিত্রলেখর সন্ধান পাওয়া যায়। সেটা ছিল এক প্রস্তর ফলকে উৎকীর্ণ শব্দাবলী। তাতে ১৩.০.০.০ তারিখটির উল্লেখ ছিল। ১৯৯৬ সালে মায়া বিশেষজ্ঞরা সেটা পাঠ করে দ্ব্যর্থবোধক ব্যাখ্যা দেন। তাঁরা বলেন, সম্ভবত এক অশুভ ঘটনার ইঙ্গিত। হয়ত অন্ধকার জগতের কোন দেবতার আবির্ভাব ঘটবে এ দিনে। তাঁরা এই ব্যাখ্যা অনলাইনে দিয়ে দেন। পরবর্তী বছরগুলোতে তা ইন্টারনেট জুড়ে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। ২০১২ সালে মহাপ্রলয়ের ধারণার প্রবক্তারা এটাকে মায়াদের ভবিষ্যদ্বাণীর প্রমাণ হিসেবে লুফে নেন। কিন্তু প্রস্তরফলকে উৎকীর্ণ লিপির বিশেষজ্ঞরা ওই চিত্রলেখার চুলচেরা বিশ্লেষণ করে ভিন্ন ভিন্ন ব্যাখ্যা হাজির করেন। তাদের সর্বসম্মত মত হলো মায়া চিত্রলিপিটি পৃথিবী ধ্বংসের কোন ভবিষ্যদ্বাণী ছিল না। ঐ প্রস্তর ফলকে মায়ারা বলেনি ২১ ডিসেম্বর ২০১২ তারিখ পৃথিবী শেষ হয়ে যাবে।
(২) সুমেরীয়দের আবিষ্কৃত গ্রহ নিবিরু আর পৃথিবীর কক্ষপথ একই রেখায় চলে আসার তত্ত্ব নিয়ে বিশ্বব্যাপী মানুষের মাঝে শুরু হয়েছে চিন্তা, ভাবনা ও আতংক। ব্যাপারটি এমন হয়ে দাঁড়িয়েছে যে, প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষ নাসার কাছে এ বিষয়ে জানতে চেয়ে চিঠি পাঠাচ্ছে। কেউ কেউ এমনও মন্তব্য করেছেন যে, ওই বিভীষিকা শুরুর আগেই তাঁরা সপরিবারে আত্মহত্যা করবেন! ভেবে দেখুন অবস্থাটা কোন পর্যায়ে গিয়ে দাঁড়িয়েছে। জনগণের মধ্যে আতংক দেখে বাধ্য হয়ে নাসা এ নিয়ে একটি বিশেষ ওয়েবসাইট খুলে সেখানে বৈজ্ঞানিক যুক্তিতর্ক দিয়ে মানুষকে আশ্বস্ত করছে যে, পৃথিবী অন্তত এ বছরেই ধ্বংস হয়ে যাওয়ার কোনও কারণ নেই। বর্তমান নাসার বিজ্ঞানীরা বলেছেন, সুমেরীয়দের আবিষ্কৃত তত্ত্বটি ছিল অনুমান নির্ভর। কারণ, তাদের সময় বৈজ্ঞানিক অগ্রগতি বর্তমান সময়ের মতো আধুনিক ছিল না। জ্ঞান-বিজ্ঞানের প্রতি তাদের প্রবল আগ্রহ ছিল সেজন্য তারা বেশ কিছু তত্ত্বের উদ্ভব ঘটিয়েছিল। তবে তাদের সকল তত্ত্ব যে সঠিক হবে সে ব্যাপারে কোনও নিশ্চয়তা নেই। নিবিরু নামের কল্পিত সেই গ্রহের সঙ্গে পৃথিবীর সাক্ষাৎ হওয়ার সম্ভাবনাও নাকচ করে দিয়েছে নাসা। নাসার এস্ট্রোবায়োলজির সিনিয়র সায়েন্টিস্ট ডেভিড মরিসন বলেছেন, ‘সুমেরীয়রা যে তত্ত্বের কথা বলেছে এ ধরনের কোনও কিছুর অস্তিত্বই নেই, সম্পূর্ণটাই কল্পনা নির্ভর। ফলে এই বিষয়ে চিন্তিত হওয়ার কিছু নেই।’
(৩) বিজ্ঞানীদের ধারনা অনুযায়ী ২০১২ সালে সানস্ট্রম ও সূর্য ঝড় পৃথিবী ধ্বংসের কারণ হবে। তাদের মতে ২০১২ সালে সূর্যের সবচেয়ে বেশি পরিমাণ এনার্জি তৈরি হবে, যার নাম ‘সোলার ম্যাক্সিমাম’। এই সৌরঝড়ের ভয়ংকর রেডিয়েশন এবং এনার্জি নির্গমনের ফলে ভূপৃষ্ঠে বা মহাকাশে যোগাযোগ ব্যবস্থা ও অন্যান্য ক্ষেত্রে নানা সমস্যা দেখা দিবে। ফলে বেড়ে যেতে পারে মানুষের অসুখ-বিসুখ, দুর্ঘটনা ও ভয়াবহ সব প্রাকৃতিক দুর্যোগ। ফলে পৃথিবী এগিয়ে যাবে চূড়ান্ত পরিণতির দিকে। অবশ্য নাসার বিজ্ঞানীরা এ বিষয়ে তাদের মতামত ব্যক্ত করেছেন। তারা বলেছেন ‘সোলার ম্যাক্সিমাম’ এর প্রভাবে ২০১২ সালটি হবে বিশ্বব্যাপী গরম বছর। এর প্রভাবে বিশ্বব্যাপী মানুষের মাঝে অসুখ-বিসুখ বেড়ে যেতে পারে, স্যাটেলাইট সিগনালে সমস্যার সৃষ্টি হতে পারে এমনকি বিশ্বব্যাপী প্রাকৃতিক দুর্যোগের সংখ্যা বৃদ্ধি পেতে পারে তবে তাতে পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যাওয়ার মতো ঘটনা ঘটবে না। যারা এমন ধারণা নির্ভর গুজব পৃথিবীর মানুষের মাঝে প্রচার করেছে তারা এটা নিয়ে বাণিজ্য করার প্রচেষ্টায় লিপ্ত রয়েছে। বিজ্ঞানী মরিসন বলেছেন, এ বছর সোলার ফ্লেয়ার একটু বেশি হবে। তবে তাতে পৃথিবী ধ্বংস নয়, বড়জোর সমস্যা হতে পারে স্যাটেলাইট যোগাযোগের ক্ষেত্রে।
(৪) ২০১২ সালে পৃথিবী ধ্বংসের আরেকটি প্রধান যে কারণ দাড় করানো হয়েছে সেটি হচ্ছে ‘লার্জ হ্যাড্রন কোলাইডার’। পৃথিবীর জন্ম রহস্য পরীক্ষা করার জন্য সুইজারল্যান্ডের জেনেভায় মাটির নিচে তৈরি করা হয়েছে মানুষের তৈরি সবচেয়ে বড় যন্ত্র লার্জ হ্যাড্রন কোলাইডার। এই পরীক্ষাটি আগে একবার করে বিজ্ঞানীরা ব্যর্থ হয়েছেন। তবে তারা এবার তথা ২০১২ সালে এই পরীক্ষাটি আবার চালানোর জন্য প্রস্তুতি নিয়েছে। এবার যে পরীক্ষাটি সফল হবে তার কোনও নিশ্চয়তা নেই। এটি যদি ব্যর্থ হয় বা কোনও প্রকার বিস্ফোরণ ঘটে তবে এর প্রভাবে ও এর রাসায়নিক পদার্থ ছড়িয়ে পড়ার ফলে বিশ্বব্যাপী মারাত্মক ধ্বংস যজ্ঞের সৃষ্টি হতে পারে। বিজ্ঞানীদের ধারনা এই পরীক্ষায় যদি কোনও দুর্ঘটনা ঘটে তবে পৃথিবীর একটি বিরাট অংশ ধ্বংস হয়ে যাবে। বিজ্ঞানীরা বলেছেন এটি হতে পারে পৃথিবীর জন্য একটি ভয়াবহ অবস্থা। অবশ্য আমরা নিজেরাই যদি নিজেদের বিপদ সৃষ্টি করি তবে তার জন্য নিশ্চয়ই ২০১২ সালেকে বা অন্য কোনও কারণকে দায়ী করলে চলবে না।
(৫) ২০১২ সালে পৃথিবী ধ্বংস হওয়ার পিছনে আরও যে কারণটি দেখানো হয়েছে সেটি হচ্ছে আমেরিকার ইয়েলোস্টোন ভলকানো আগ্নেয়গিরির বিস্ফোরণ। মোটামুটি প্রতি ৬,৫০,০০০ বছর পর ভয়ংকর অগ্ন্যুৎপাত হয় এই আগ্নেয়গিরি থেকে। গবেষণা অনুসারে বলা হয়েছে ২০১২ সালে আবার ভয়ংকর বিস্ফোরণ ঘটবে ইয়োলোস্টোনে এবং তাতেই ধ্বংস হবে পৃথিবী। পৃথিবী ধ্বংসের এই মতবাদটির উত্তরে অন্য বিজ্ঞানীরা বলেছেন ধারনা করা হয় প্রতি ৬,৫০,০০০ বছর পর পর ভয়ংকর অগ্ন্যুৎপাত হয় এই আগ্নেয়গিরি থেকে তবে এবারও যে সেই একই ক্ষণ গণনা করে একইভাবে ২০১২ সালে আবার আগ্নেয়গিরির বিস্ফোরণ ঘটবে এবং তাতেই পৃথিবী ধ্বংস হবে এ ধরনের মতবাদের কোনও ভিত্তি নেই। আশার কথা এই যে, এখনও পর্যন্ত এই আগ্নেয়গিরি থেকে ২০১২ সালে অগ্নুৎপাতের কোনও আশংকা দেখা যায় নি। ফলে এটিও প্রমাণিত হতে যাচ্ছে একটি গুজবে।
(৬) ভাল-মন্দের শেষ যুদ্ধ হিসেবে একটি ভয়াবহ পরিণতির কথা বলা হয়েছে পবিত্র বাইবেলে। আর তা ঘটার সময় হিসেবে ২০১২ সালের দিকে ইঙ্গিত করা হয়েছে। তবে ধর্মবেত্তাদের মত এই যে, এমন একটি পরিণতির কথা বলা হয়েছে তবে সেটি যে ২০১২ সালেই হবে সেটির কোনও প্রমাণ নেই। কারণ পবিত্র বাইবেলের ইঙ্গিত হিসেবে অনেকে ২০১২ সালকে বেছে নিয়েছে তবে সেটি অবশ্যই ২০১২ সাল না হয়ে অন্য কোনও সময়ও হতে পারে। এছাড়া মহাগ্রন্থ আল কুরআন ও আল হাদিসের বর্ণনা অনুসারে পৃথিবী ধ্বংস বা কেয়ামতের আগে বেশ কয়েকটি আলামতের কথা বর্ণনা করা হয়েছে। যার মধ্যে কিছু আলামত আছে ছোট এবং কয়েকটি আছে বড়। ছোট আলামতগুলো ইতোমধ্যে সম্পন্ন হলেও বড় আলামত গুলো এখনও দেখা যায়নি। হাদীসের বর্ণনা অনুসারে কিয়ামত সংঘটিত হবে পৃথিবীতে এই বড় আলামতগুলো সংঘটিত হওয়ার পর। পৃথিবীতে কিয়ামতের এই বড় আলামতগুলো এখনও দেখা যায়নি ফলে নিশ্চিন্তে বলা যায় এখনও পৃথিবী ধ্বংসের সময় আসেনি।
ইসলামের দৃষ্টিতে: প্রত্যেক মুসলমানকে মনে প্রাণে বিশ্বাস রাখতে হবে যে, মহান আল্লাহ রব্বুল আলামিন এই পৃথিবী সৃষ্টি করেছেন এবং একদিন তিনি আবার এই পৃথিবীর ধ্বংস সাধন করবেন। যে দিনটিতে পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যাবে সেই দিনটিকে বলা হয় কিয়ামতের দিন। এখন প্রশ্ন হচ্ছে ২০১২ সালের ২১ ডিসেম্বর তারিখ কিয়ামত সংঘটিত হবে কিনা ! কিয়ামত সংঘটিত হওয়ার পূর্ব লক্ষণ হিসেবে বেশ কিছু ছোট ও বড় চিহ্নের কথা মোহাম্মদ (সাঃ) হাদিসে উল্লেখ করেছেন। ছোট চিহ্নগুলো পৃথিবীতে দেখা গেলেও বড় চিহ্ন গুলো এখনও দেখা যায়নি। বড় চিহ্নগুলোর মধ্যে রয়েছে ইয়াজুজ-মাজুজ, দুমাতুল জান্দাল, দাজ্জাল, ইমাম মাহদী, ঈসা (আঃ) এর পৃথিবীতে আগমন প্রভৃতি। কিয়ামতের এই বড় আলামতগুলো এখনও দেখা যায়নি। সুতরাং ২১ ডিসেম্বর তারিখে কিয়ামত হওয়ার কোনও আশংকা নেই। অনেকে বলতে পারেন ২১ ডিসেম্বর তারিখের আগে হয়তো এই আলামতগুলো দেখা হয়ে যাবে। এর উত্তরে বলা যায়, হাদিসে এসেছে ইমাম মাহদী পৃথিবীতে এসে প্রায় ৭/৯ বছর অবস্থান করবেন, দাজ্জাল পৃথিবীতে দীর্ঘদিন ফেতনা সৃষ্টি করবে, ইমাম মাহদীর পরে ঈসা (আঃ) পৃথিবীতে আগমন করবেন। তাই যদি হয় তবে ২১ ডিসেম্বর কেয়ামত হওয়া অসম্ভব। হাদিসে এসেছে মোহাম্মদ (সাঃ) বলেছেন কিয়ামত কবে হবে এ বিষয়ে আল্লাহ ছাড়া আর কেউ জানে না। এমনকি তার ফেরেশতা ও নবী-রাসুলেরাও জানেন না এবং কোনও দিন জানতেও পারবেন না। তিনি আরও বলেছেন পূর্বে জানা তো দূরের কথা যেদিন কিয়ামত আরম্ভ হবে সেদিনও মানুষেরা জানতে পারবে না যে আজ কেয়ামত হবে। ঈস্রাফিল (আঃ) এর ফুঁৎকারে যখন কিয়ামত শুরু হবে তখন মানুষের চারদিক ছুটাছুটি করবে আর বলবে আজ পৃথিবীর কী হয়েছে? সুতরাং ২১ তারিখ কিয়ামত হওয়ার বিষয়টি সম্পূর্ণ মিথ্যা।
এই সকল ভ্রান্ত মতবাদ মুসলমানদের ঈমান-হারা করে দিতে পারে। এই বিষয়ে সকল মুসলমানদের বিশ্বাস থাকতে হবে যে, কিয়ামত কবে হবে সেটা শুধুমাত্র এক আল্লাহ জানেন। কোনও মুসলমান যদি মানুষের দেয়া কোনও দিন তারিখকে বিশ্বাস করে থাকেন তবে তিনি ঈমান-হারা হয়ে মুশরিক হয়ে যাবেন।
সর্বশেষে বলা যায়, পৃথিবী ধ্বংসের তারিখ এর আগে কয়েকবার ঘোষণা করা হয়েছিল কিন্তু প্রতিবারই মানুষের এই ভবিষ্যৎ বাণী মিথ্যাই পরিণত হয়েছে। মিথ্যাচার, বাণিজ্য বা সতর্ক করা যে কারণেই হোক না কেন মায়া ক্যালেন্ডার সহ বেশ কিছু সূত্রকে উপাদান বানিয়ে আবারও ঘোষণা করা হয়েছে পৃথিবী ধ্বংসের তারিখ। তবে বিশেষজ্ঞ মহল ও বিজ্ঞানীরা ইতোমধ্যে ২০১২ সালে ডিসেম্বরের ২১ তারিখের পৃথিবী ধ্বংসের মতবাদকে মিথ্যা হিসেবে প্রমাণ করেছেন। তাই পরিশেষে এটাই বলা যায়, ২০১২ সালে পৃথিবী ধ্বংসের খবর মিথ্যা ও গুজব। তবে একটি আশংকা চিন্তার কারণ হয়ে থাকছে। আর সেটি হচ্ছে লার্জ হ্যাড্রন কোলাইডার পরীক্ষা। এই পরীক্ষাটি যদি এই বছর চালানো হয় এবং সেটি যদি কোনও দুর্ঘটনার সৃষ্টি করে তবে নিজেদের বিপদ নিজেরা নিয়ে এসে সেটির দোষ ২০১২ সাল বা অন্য কারও দেওয়া উচিৎ হবে না।
(copy)
Blogger Comment
Facebook Comment