২০১১ পুঁজিবাজারের ইতিহাসে একটি স্মরনীয় অধ্যায় । ইতিহাসের নজীরবিহীন
অস্থিরতার মধ্য দিয়ে বছরটি পার করল দেশের প্রধান পুঁজিবাজার। ২০১০ সালে
ব্যাপক উত্থানের পর ডিসেম্বর মাসে শুরু হয় পতন প্রক্রিয়া। যার ফলে বছরজুড়ে
ব্যাপক অস্থিরতা বিরাজ করে পুঁজিবাজারে ।
এরই জের ধরে রাজধানীর মতিঝিলে বিনিয়োগকারী ঐক্যপরিষদের ব্যানারে ঐক্য বদ্ধ হয়ে আন্দোলনে নামে । এতে ব্যাপক বিক্ষোভ, মিছিল, সড়ক অবরোধ, ভাঙচুর, পুলিশের সঙ্গে বিনিয়োগকারীদের ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া, মামলা-হামলা,অগ্নিসংযোগেরও ঘটনা ঘটে।
এত কিছুর পরও টনক নড়েনি সরকারের ওপর মহলের। উল্টো বিভিন্ন সময় সরকারের ওপর মহল থেকে করা হয় বিরূপ মন্তব্য, যা বিনিয়োগকারীদের আস্থার সংকট তরান্বিত করতে সহায়তা করে। অবশেষে গত মাসের মাঝামাঝিতে হস্তক্ষেপ করেন খোদ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি পুঁজিবাজার সংশ্লিষ্ট সব পক্ষের সঙ্গে গণভবনে দীর্ঘক্ষণ বৈঠক করেন। একই সঙ্গে পুঁজিবাজারে স্থিতিশীলতা আনতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণের নির্দেশ দেন সংশ্লিষ্ট সবাইকে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে গত ২৩ নভেম্বর সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের পক্ষ থেকে বিশেষ প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করা হয়। এরপর থেকে বাজারে কিছুটা হলেও স্বস্তি ফিরে আসে বিনিয়োগকারীদের মাঝে।
এ দিকে গত ডিসেম্বরে শুরু হওয়া দরপতন অব্যাহত থাকলেও সংশ্লিষ্ট পক্ষের নানা উদ্যোগও কোনো কাজে আসেনি। এতে দুই স্টক এক্সচেঞ্জের মূল্যসূচক, আর্থিক লেনদেন, বাজার মূলধন কমেছে। সব মিলিয়ে ২০১১ সাল পুঁজিবাজারের জন্য অস্থিরতার বছর হিসেবে চিহ্নিত হয়ে থাকবে। অন্যদিকে পুঁজিাবাজারে কারসাজি তদন্তে গঠিত কমিটি তাঁদের প্রতিবেদন প্রকাশ করলেও সরকারের পক্ষ থেকে তেমন কোনো পদক্ষেপ নেয়া হয়নি।
২০১০ সালের ৫ ডিসেম্বর ডিএসইর সাধারণ সূচক ছিল ৮,৯১৮ পয়েন্টে, যা দেশের পুঁজিবাজার ইতিহাসের সর্বোচ্চ রেকর্ড। পরদিনই শুরু হয় দরপতন। এরই ধারাবাহিকতায় ২০১১ সালের ১১ জানুয়ারি ভয়াবহ ধস নামে দেশের পুঁজিবাজারে। ওইদিন লেনদেন শুরু হওয়ার ৫ মিনিটের মাথায় কেউ কোনো কিছু বুঝে ওঠার আগেই ডিএসইর সাধারণ মূল্যসূচক ৬৩৫ পয়েন্ট পড়ে যায়। আরও সূচক পতনের আশংকায় এসইসি ওইদিন লেনদেন স্থগিত করে দেয়। অন্যদিকে পুঁজি হারিয়ে নি:স্ব বিনিয়োগকারীরা ওইদিন থেকেই শুরু করে বিক্ষোভ, যা বলা যায় পুরো বছর জুড়েই অব্যাহত ছিল।
ডিএসইর গত বছরের বাজার পর্যালোচনায় উল্লেখযোগ্য বিষয়গুলো হলো-
সূচকের পতন: ২০১১ সালের প্রথম কর্ম দিবস ২ জানুয়ারি ডিএসইর সাধারণ মূল্যসূচক ১৪ পয়েন্ট বেড়ে দাঁড়িয়েছিল ৮৩০৫ পয়েন্টে। আবার একই বছরের শেষ কার্যদিবস গত বৃহস্পতিবার ডিএসইর সাধারণ মূল্যসূচক ৩৬ পয়েন্ট বেড়ে ৫২৫৭ পয়েন্টে দাঁড়ায়। তবে এ হিসাবে সার্বিকভাবে এক বছরে সূচক কমেছে ৩০৪৮ পয়েন্টের মত।
লেনদেনযোগ্য সিকিউরিটিজ: ডিএসই সূত্রে জানা যায়, ডিএসই ২০১১ সালের ২৯ ডিসেম্বর পর্যন্ত তালিকাভুক্ত মোট সিকিউরিটিজের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৫০১টিতে। এর মধ্যে কোম্পানি ২৩২টি, মিউচুয়াল ফান্ড ৩৭টি, ডিবেঞ্চার আটটি, ট্রেজারি বন্ড ২২১টি ও করপোরেট বন্ড তিনটি। যার মোট শেয়ার/সার্টিফিকেট সংখ্যা তিন হাজার ১৭০ কোটি ৯০ লাখ এবং মোট ইস্যুকৃত মূলধন ৮৭ হাজার ৭৫৫ কেটি ৫০ লাখ টাকা। ২০১০ সালের ৩০ ডিসেম্বরে তালিকাভুক্ত মোট সিকিউরিটিজের সংখ্যা ছিল ৪৪৫টি। যার মধ্যে কোম্পানি ২১৮টি, মিউচুয়াল ফান্ড ৩১টি, ডিবেঞ্চার ৮টি, ট্রেজারি বন্ড ১৮৬টি কর্পোরেট বন্ড ২টি। যার মোট শেয়ার বা সার্টিফিকেট সংখ্যা এক হাজার ৪৫৩ কোটি ৭০ লাখ এবং মোট ইস্যুকৃত মূলধন ৬৬ হাজার ৪৩৬ কোটি টাকা।
বাজার মূলধন: ২০১০ সালের ৩০ ডিসেম্বর ডিএসইর বাজার মূলধন ছিল তিন লাখ ৫০ হাজার কোটি টাকা, যা গত ৩০ ডিসেম্বর হ্রাস পেয়ে দাঁড়িয়েছে দুই লাখ ৬১ হাজার কোটি টাকায়। এ হিসেবে গত এক বছরে বাজার মূলধনের পরিমাণ কমেছে ৩৪ শতাংশ বা ৮৯ হাজার কোটি টাকা। এদিকে ২০১০ সালের ৫ ডিসেম্বর ডিএসইর বাজার মূলধন সর্বকালের রেকর্ড অতিক্রম করে তিন লাখ ৬৮ হাজার কোটি টাকায় উন্নীত হয়। আর এক বছরে বাজার মূলধন জিডিপির অনুপাতে ৫০.৬৭ শতাংশ থেকে কমে ৩৩.২৩ শতাংশে দাঁড়িয়েছে।
সিকিউরিটিজ লেনদেন: ২০১১ সালে ডিএসইতে এক হাজার ৬৯৬ কোটি ৭১ লাখ ৪৮ হাজার ২২৮টি সিকিউরিটিজ লেনদেন হয়, যার মোট মূল্য এক কোটি ৫৬ লাখ ৯৯ কোটি ২০ লাখ ৮৮ হাজার ২৯১ টাকা। আর ২০১১ সালে মোট লেনদেন দিবসের সংখ্যা ছিল ২৩৫দিন, গড়ে প্রতিদিন সাত কোটি ২২ লাখ ৬৩০টি সিকিউরিটিজ লেনদেন হয় এবং গড়ে টাকায় লেনদেন হয় ৬৬৪ কোটি ২১ লাখ ৭৯ হাজার ৯৯ টাকা।
অন্যদিকে ২০১০ সালে এক হাজার ৬৯৭ কোটি ৪৫ লাখ ১৯ হাজার ৬৬৭টি সিকিউরিটিজের লেনদেন হয়। যার মোট মূল্য চার লাখ ৯৯১ কোটি ২৬ লাখ ৬৮ হাজার ২৪১ টাকা। ২০১০ সালে মোট লেনদেন হয়েছে ২৪৪দিন, গড় লেনদেন হয় ৬ কোটি ৯৫ লাখ ৬৭ হাজার ৭০৩টি সিকিউরিটিজ এবং গড় মূল্য টাকায় এক হাজার ৬৪৩ কোটি ৪০ লাখ ৬৮ হাজার ৩১২ টাকা।
মার্কেট ক্যাপিটালাইজেশন টু জিডিপির অনুপাত: ২০০৯ সালের ১ জানুয়ারি ডিএসইর মার্কেট ক্যাপিটালইজেশন টু জিডিপি অনুপাত ছিল ১৯.৭৪ পয়েন্ট। যা ২০১০ সালের ৩০ ডিসেম্বর বেড়ে ৫০.৬৭ শতাংশে উন্নীত হয়। তবে ২০১১ সালের ২৯ ডিসেম্বর তা কমে দাঁড়িয়েছে ৩৩.২৩ শতাংশে।
আইপিও: ২০১১ সালে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে একটি ফিক্সড ইনকাম ফান্ড ও ছয়টি মিউচুয়াল ফান্ডসহ মোট ১৪টি সিকিউরিটিজ বাজারে আসে। এর মাধ্যমে এক হাজার ৮৭৯ কোটি ১৬ লাখ ১০০ টাকার পরিশোধিত মূলধন প্রাথমিক গণপ্রস্তাবের (আইপিও) মাধ্যমে বাজারে আসে। প্রিমিয়ামসহ এক হাজার ৯৯১ কোটি ৪১ লাখ ৪৫ হাজার ২০০ টাকার শেয়ার সাধারণ বিনিয়োগকারীদের জন্য বরাদ্দ থাকে।
তালিকাভুক্ত সিকিউরিটিজ: ২০১১ সালে ডিএসইতে মোট এক হাজার ৭১৯ কোটি ১০ লাখ টাকার পরিশোধিত মূলধনসম্পন্ন ১৫টি সিকিউরিটিজ ডিএসইতে তালিকাভুক্ত হয়। এর মধ্যে ছয়টি মিউচুয়াল ফান্ড, একটি কনভার্টেবল বন্ডসহ মোট ১৫টি কোম্পানি। আর ২০১০ সালে ডিএসইতে রেকর্ড সংখ্যক সিকিউরিটিজ তালিকাভুক্ত হয়। ২০১০ সালে এই সংখ্যা ছিল তিন হাজার ৯৭ কোটি ৭০ লাখ টাকার পরিশোধিত মূলধন সম্পন্ন ২৫টি সিকিউরিটিজ।
সরকারের রাজস্ব আয়: ডিএসইতে শেয়ার লেনদেনের ওপর উৎসে কর সংগ্রহ করে ২০১১-২০১২ অর্থবছরের প্রথম ছয় মাস জুলাই থেকে ডিসেম্বর ২০১১ পর্যন্ত ১১৭ কোটি ৬২ লাখ টাকা সরকারি কোষাগারে জমা দেওয়া হয়েছে। এর আগে জুলাই থেকে জুন ২০১০-২০১১ অর্থবছরে ৩২৫ কোটি ৯১ লাখ টাকা সরকারি কোষাগারে জমা দেওয়া হয়।
বছরের উল্লেখযোগ্য ঘটনা-
এসইসি পুনর্গঠন: শেয়ারবাজারে কারসাজির ঘটনা তদন্তে গঠিত কমিটির সুপারিশ অনুযায়ী পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (্এসইসি) পুনর্গঠন করা হয়েছে। আগের কমিশনকে সরিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফাইন্যান্স বিভাগের অধ্যাপক এম খায়রুল হোসেনকে এসইসির চেয়ারম্যান হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। কমিশনের অন্য সদস্যরা হলেন, হেলাল উদ্দিন নিজামী, আরিফ খান, আমজাদ হোসেন, আবদুস সালাম সিকদার।
বাংলাদেশ ফান্ড: বাজারে অর্থ প্রবাহ বৃদ্ধির লক্ষে গত ২৮ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ ফান্ড নামে পাঁচ হাজার কোটি টাকার তহবিল গঠনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। তহবিলটির মূল উদ্যোক্তা ইনভেস্টমেন্ট করপোরেশন অব বাংলাদেশ (আইসিবি)। এ ছাড়া চার রাষ্ট্রায়ত্ব ব্যাংক- সোনালী, রূপালী, আগ্রণী, জনতা, জীবন বীমা করপোরেশন, সাধারণ বীমা করপোরেশন ও বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক লিমিটেড (বিডিবিএল) সহ উদ্যোক্তা হিসেবে রয়েছে।
বাজার স্থিতিশীলকরণ তহবিল: পুঁজিবাজারে স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করতে পাঁচ হাজার কোটি টাকার বাজার স্থিতিশীল করণ তহবিল (এমএসএফ) নামে আরেকটি তহবিল গঠনেরও সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। বেসরকারী বাণিজ্যিক ব্যাংকের মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকসের (বিএবি) পক্ষ থেকে এই তহবিল গঠনের উদ্যোগ নেওয়া হয়।
কালো টাকা বিনিয়োগে প্রশ্ন করবে না এনবিআর: গত ২০ নভেম্বর অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের সঙ্গে পুঁজিবাজার সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের প্রধানদের সঙ্গে বৈঠকে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়, পুঁজিবাজারে কালো টাকা বিনিয়োগে কোনো ধরণের প্রশ্ন করবে না জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। ওই দিন দীর্ঘ আড়াই ঘণ্টা বৈঠক শেষে এসইসির সদস্য হেলাল উদ্দিন নেজামী সাংবাদিকদের বলেন, প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা অনুযায়ী ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের স্বার্থ রক্ষায় আমরা সচেষ্ট রয়েছি। পুজিবাজার স্থিতিশীল করতে যে সকল পদক্ষেপ নেয়া প্রয়োজন বর্তমান সরকার তার সবই নেবে। তিনি বলেন, অপ্রদর্শিত অর্থ বা কালো টাকা বিনিয়োগের বিষয়ে অনেকই সন্দেহ প্রকাশ করেছেন। বৈঠকে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের চেয়ারম্যান নিশ্চিত করেছেন পুঁজিবাজারে কালো টাকা বিনিয়োগের বিষয়ে কোনো সন্দেহের অবকাশ নাই। পরে এনবিআর থেকে দেওয়া স্পষ্টিকরণে পুঁজিবাজারে অপ্রদর্শিত আয় বা কালো টাকা বিনিয়োগ করলে কোন প্রশ্ন তোলা হবে না বলে নিশ্চয়তা দেওয়া হয়।
ডিমিউচুয়ালাইজেশনের ধারণাপত্র: ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই) ও চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জ (সিএসই) ডিমিউচুয়ালাইজেশন করা হচ্ছে। গত ২৯ ডিসেম্বর দুই স্টক এক্সচেঞ্জ তাদের ডিমিউচুয়ালাইজেশনের ধারণাপত্র অর্থমন্ত্রণালয়ে জমা দেয়।
উদ্যোক্তা-পরিচালকদের ৩০ শতাংশ শেয়ার সংরক্ষণ: তালিকাভুক্ত কোম্পানির উদ্যোক্তা-পরিচালকদের ৩০ শতাংশ এবং ব্যক্তিগতভাবে দুই শতাংশ শেয়ার সংরক্ষণ করতে হবে। সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (এসইসি) এ সংক্রান্ত নির্দেশনা সম্প্রতি গেজেট আকারে প্রকাশ করা হয়েছে।
প্রণোদনা প্যাকেজ: পুঁজিবাজার স্থিতিশীলতা আনতে নতুন বিনিয়োগ বৃদ্ধির মাধ্যমে বাজারকে গতিশীল করার প্রতি সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে এবং ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের স্বার্থ রক্ষায় স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদী পদক্ষেপের সমন্বয়ে বিশেষ প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেন এসইসির চেয়ারম্যান অধ্যাপক এম খায়রুল হোসন। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশের পরিপ্রেক্ষিতে এসইসির চেয়ারম্যান এই প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেন, যার ইতিবাচক প্রভাব পড়তে শুরু করেছে বলে বাজার সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা মনে করছেন।
এরই জের ধরে রাজধানীর মতিঝিলে বিনিয়োগকারী ঐক্যপরিষদের ব্যানারে ঐক্য বদ্ধ হয়ে আন্দোলনে নামে । এতে ব্যাপক বিক্ষোভ, মিছিল, সড়ক অবরোধ, ভাঙচুর, পুলিশের সঙ্গে বিনিয়োগকারীদের ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া, মামলা-হামলা,অগ্নিসংযোগেরও ঘটনা ঘটে।
এত কিছুর পরও টনক নড়েনি সরকারের ওপর মহলের। উল্টো বিভিন্ন সময় সরকারের ওপর মহল থেকে করা হয় বিরূপ মন্তব্য, যা বিনিয়োগকারীদের আস্থার সংকট তরান্বিত করতে সহায়তা করে। অবশেষে গত মাসের মাঝামাঝিতে হস্তক্ষেপ করেন খোদ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি পুঁজিবাজার সংশ্লিষ্ট সব পক্ষের সঙ্গে গণভবনে দীর্ঘক্ষণ বৈঠক করেন। একই সঙ্গে পুঁজিবাজারে স্থিতিশীলতা আনতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণের নির্দেশ দেন সংশ্লিষ্ট সবাইকে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে গত ২৩ নভেম্বর সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের পক্ষ থেকে বিশেষ প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করা হয়। এরপর থেকে বাজারে কিছুটা হলেও স্বস্তি ফিরে আসে বিনিয়োগকারীদের মাঝে।
এ দিকে গত ডিসেম্বরে শুরু হওয়া দরপতন অব্যাহত থাকলেও সংশ্লিষ্ট পক্ষের নানা উদ্যোগও কোনো কাজে আসেনি। এতে দুই স্টক এক্সচেঞ্জের মূল্যসূচক, আর্থিক লেনদেন, বাজার মূলধন কমেছে। সব মিলিয়ে ২০১১ সাল পুঁজিবাজারের জন্য অস্থিরতার বছর হিসেবে চিহ্নিত হয়ে থাকবে। অন্যদিকে পুঁজিাবাজারে কারসাজি তদন্তে গঠিত কমিটি তাঁদের প্রতিবেদন প্রকাশ করলেও সরকারের পক্ষ থেকে তেমন কোনো পদক্ষেপ নেয়া হয়নি।
২০১০ সালের ৫ ডিসেম্বর ডিএসইর সাধারণ সূচক ছিল ৮,৯১৮ পয়েন্টে, যা দেশের পুঁজিবাজার ইতিহাসের সর্বোচ্চ রেকর্ড। পরদিনই শুরু হয় দরপতন। এরই ধারাবাহিকতায় ২০১১ সালের ১১ জানুয়ারি ভয়াবহ ধস নামে দেশের পুঁজিবাজারে। ওইদিন লেনদেন শুরু হওয়ার ৫ মিনিটের মাথায় কেউ কোনো কিছু বুঝে ওঠার আগেই ডিএসইর সাধারণ মূল্যসূচক ৬৩৫ পয়েন্ট পড়ে যায়। আরও সূচক পতনের আশংকায় এসইসি ওইদিন লেনদেন স্থগিত করে দেয়। অন্যদিকে পুঁজি হারিয়ে নি:স্ব বিনিয়োগকারীরা ওইদিন থেকেই শুরু করে বিক্ষোভ, যা বলা যায় পুরো বছর জুড়েই অব্যাহত ছিল।
ডিএসইর গত বছরের বাজার পর্যালোচনায় উল্লেখযোগ্য বিষয়গুলো হলো-
সূচকের পতন: ২০১১ সালের প্রথম কর্ম দিবস ২ জানুয়ারি ডিএসইর সাধারণ মূল্যসূচক ১৪ পয়েন্ট বেড়ে দাঁড়িয়েছিল ৮৩০৫ পয়েন্টে। আবার একই বছরের শেষ কার্যদিবস গত বৃহস্পতিবার ডিএসইর সাধারণ মূল্যসূচক ৩৬ পয়েন্ট বেড়ে ৫২৫৭ পয়েন্টে দাঁড়ায়। তবে এ হিসাবে সার্বিকভাবে এক বছরে সূচক কমেছে ৩০৪৮ পয়েন্টের মত।
লেনদেনযোগ্য সিকিউরিটিজ: ডিএসই সূত্রে জানা যায়, ডিএসই ২০১১ সালের ২৯ ডিসেম্বর পর্যন্ত তালিকাভুক্ত মোট সিকিউরিটিজের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৫০১টিতে। এর মধ্যে কোম্পানি ২৩২টি, মিউচুয়াল ফান্ড ৩৭টি, ডিবেঞ্চার আটটি, ট্রেজারি বন্ড ২২১টি ও করপোরেট বন্ড তিনটি। যার মোট শেয়ার/সার্টিফিকেট সংখ্যা তিন হাজার ১৭০ কোটি ৯০ লাখ এবং মোট ইস্যুকৃত মূলধন ৮৭ হাজার ৭৫৫ কেটি ৫০ লাখ টাকা। ২০১০ সালের ৩০ ডিসেম্বরে তালিকাভুক্ত মোট সিকিউরিটিজের সংখ্যা ছিল ৪৪৫টি। যার মধ্যে কোম্পানি ২১৮টি, মিউচুয়াল ফান্ড ৩১টি, ডিবেঞ্চার ৮টি, ট্রেজারি বন্ড ১৮৬টি কর্পোরেট বন্ড ২টি। যার মোট শেয়ার বা সার্টিফিকেট সংখ্যা এক হাজার ৪৫৩ কোটি ৭০ লাখ এবং মোট ইস্যুকৃত মূলধন ৬৬ হাজার ৪৩৬ কোটি টাকা।
বাজার মূলধন: ২০১০ সালের ৩০ ডিসেম্বর ডিএসইর বাজার মূলধন ছিল তিন লাখ ৫০ হাজার কোটি টাকা, যা গত ৩০ ডিসেম্বর হ্রাস পেয়ে দাঁড়িয়েছে দুই লাখ ৬১ হাজার কোটি টাকায়। এ হিসেবে গত এক বছরে বাজার মূলধনের পরিমাণ কমেছে ৩৪ শতাংশ বা ৮৯ হাজার কোটি টাকা। এদিকে ২০১০ সালের ৫ ডিসেম্বর ডিএসইর বাজার মূলধন সর্বকালের রেকর্ড অতিক্রম করে তিন লাখ ৬৮ হাজার কোটি টাকায় উন্নীত হয়। আর এক বছরে বাজার মূলধন জিডিপির অনুপাতে ৫০.৬৭ শতাংশ থেকে কমে ৩৩.২৩ শতাংশে দাঁড়িয়েছে।
সিকিউরিটিজ লেনদেন: ২০১১ সালে ডিএসইতে এক হাজার ৬৯৬ কোটি ৭১ লাখ ৪৮ হাজার ২২৮টি সিকিউরিটিজ লেনদেন হয়, যার মোট মূল্য এক কোটি ৫৬ লাখ ৯৯ কোটি ২০ লাখ ৮৮ হাজার ২৯১ টাকা। আর ২০১১ সালে মোট লেনদেন দিবসের সংখ্যা ছিল ২৩৫দিন, গড়ে প্রতিদিন সাত কোটি ২২ লাখ ৬৩০টি সিকিউরিটিজ লেনদেন হয় এবং গড়ে টাকায় লেনদেন হয় ৬৬৪ কোটি ২১ লাখ ৭৯ হাজার ৯৯ টাকা।
অন্যদিকে ২০১০ সালে এক হাজার ৬৯৭ কোটি ৪৫ লাখ ১৯ হাজার ৬৬৭টি সিকিউরিটিজের লেনদেন হয়। যার মোট মূল্য চার লাখ ৯৯১ কোটি ২৬ লাখ ৬৮ হাজার ২৪১ টাকা। ২০১০ সালে মোট লেনদেন হয়েছে ২৪৪দিন, গড় লেনদেন হয় ৬ কোটি ৯৫ লাখ ৬৭ হাজার ৭০৩টি সিকিউরিটিজ এবং গড় মূল্য টাকায় এক হাজার ৬৪৩ কোটি ৪০ লাখ ৬৮ হাজার ৩১২ টাকা।
মার্কেট ক্যাপিটালাইজেশন টু জিডিপির অনুপাত: ২০০৯ সালের ১ জানুয়ারি ডিএসইর মার্কেট ক্যাপিটালইজেশন টু জিডিপি অনুপাত ছিল ১৯.৭৪ পয়েন্ট। যা ২০১০ সালের ৩০ ডিসেম্বর বেড়ে ৫০.৬৭ শতাংশে উন্নীত হয়। তবে ২০১১ সালের ২৯ ডিসেম্বর তা কমে দাঁড়িয়েছে ৩৩.২৩ শতাংশে।
আইপিও: ২০১১ সালে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে একটি ফিক্সড ইনকাম ফান্ড ও ছয়টি মিউচুয়াল ফান্ডসহ মোট ১৪টি সিকিউরিটিজ বাজারে আসে। এর মাধ্যমে এক হাজার ৮৭৯ কোটি ১৬ লাখ ১০০ টাকার পরিশোধিত মূলধন প্রাথমিক গণপ্রস্তাবের (আইপিও) মাধ্যমে বাজারে আসে। প্রিমিয়ামসহ এক হাজার ৯৯১ কোটি ৪১ লাখ ৪৫ হাজার ২০০ টাকার শেয়ার সাধারণ বিনিয়োগকারীদের জন্য বরাদ্দ থাকে।
তালিকাভুক্ত সিকিউরিটিজ: ২০১১ সালে ডিএসইতে মোট এক হাজার ৭১৯ কোটি ১০ লাখ টাকার পরিশোধিত মূলধনসম্পন্ন ১৫টি সিকিউরিটিজ ডিএসইতে তালিকাভুক্ত হয়। এর মধ্যে ছয়টি মিউচুয়াল ফান্ড, একটি কনভার্টেবল বন্ডসহ মোট ১৫টি কোম্পানি। আর ২০১০ সালে ডিএসইতে রেকর্ড সংখ্যক সিকিউরিটিজ তালিকাভুক্ত হয়। ২০১০ সালে এই সংখ্যা ছিল তিন হাজার ৯৭ কোটি ৭০ লাখ টাকার পরিশোধিত মূলধন সম্পন্ন ২৫টি সিকিউরিটিজ।
সরকারের রাজস্ব আয়: ডিএসইতে শেয়ার লেনদেনের ওপর উৎসে কর সংগ্রহ করে ২০১১-২০১২ অর্থবছরের প্রথম ছয় মাস জুলাই থেকে ডিসেম্বর ২০১১ পর্যন্ত ১১৭ কোটি ৬২ লাখ টাকা সরকারি কোষাগারে জমা দেওয়া হয়েছে। এর আগে জুলাই থেকে জুন ২০১০-২০১১ অর্থবছরে ৩২৫ কোটি ৯১ লাখ টাকা সরকারি কোষাগারে জমা দেওয়া হয়।
বছরের উল্লেখযোগ্য ঘটনা-
এসইসি পুনর্গঠন: শেয়ারবাজারে কারসাজির ঘটনা তদন্তে গঠিত কমিটির সুপারিশ অনুযায়ী পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (্এসইসি) পুনর্গঠন করা হয়েছে। আগের কমিশনকে সরিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফাইন্যান্স বিভাগের অধ্যাপক এম খায়রুল হোসেনকে এসইসির চেয়ারম্যান হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। কমিশনের অন্য সদস্যরা হলেন, হেলাল উদ্দিন নিজামী, আরিফ খান, আমজাদ হোসেন, আবদুস সালাম সিকদার।
বাংলাদেশ ফান্ড: বাজারে অর্থ প্রবাহ বৃদ্ধির লক্ষে গত ২৮ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ ফান্ড নামে পাঁচ হাজার কোটি টাকার তহবিল গঠনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। তহবিলটির মূল উদ্যোক্তা ইনভেস্টমেন্ট করপোরেশন অব বাংলাদেশ (আইসিবি)। এ ছাড়া চার রাষ্ট্রায়ত্ব ব্যাংক- সোনালী, রূপালী, আগ্রণী, জনতা, জীবন বীমা করপোরেশন, সাধারণ বীমা করপোরেশন ও বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক লিমিটেড (বিডিবিএল) সহ উদ্যোক্তা হিসেবে রয়েছে।
বাজার স্থিতিশীলকরণ তহবিল: পুঁজিবাজারে স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করতে পাঁচ হাজার কোটি টাকার বাজার স্থিতিশীল করণ তহবিল (এমএসএফ) নামে আরেকটি তহবিল গঠনেরও সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। বেসরকারী বাণিজ্যিক ব্যাংকের মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকসের (বিএবি) পক্ষ থেকে এই তহবিল গঠনের উদ্যোগ নেওয়া হয়।
কালো টাকা বিনিয়োগে প্রশ্ন করবে না এনবিআর: গত ২০ নভেম্বর অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের সঙ্গে পুঁজিবাজার সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের প্রধানদের সঙ্গে বৈঠকে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়, পুঁজিবাজারে কালো টাকা বিনিয়োগে কোনো ধরণের প্রশ্ন করবে না জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। ওই দিন দীর্ঘ আড়াই ঘণ্টা বৈঠক শেষে এসইসির সদস্য হেলাল উদ্দিন নেজামী সাংবাদিকদের বলেন, প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা অনুযায়ী ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের স্বার্থ রক্ষায় আমরা সচেষ্ট রয়েছি। পুজিবাজার স্থিতিশীল করতে যে সকল পদক্ষেপ নেয়া প্রয়োজন বর্তমান সরকার তার সবই নেবে। তিনি বলেন, অপ্রদর্শিত অর্থ বা কালো টাকা বিনিয়োগের বিষয়ে অনেকই সন্দেহ প্রকাশ করেছেন। বৈঠকে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের চেয়ারম্যান নিশ্চিত করেছেন পুঁজিবাজারে কালো টাকা বিনিয়োগের বিষয়ে কোনো সন্দেহের অবকাশ নাই। পরে এনবিআর থেকে দেওয়া স্পষ্টিকরণে পুঁজিবাজারে অপ্রদর্শিত আয় বা কালো টাকা বিনিয়োগ করলে কোন প্রশ্ন তোলা হবে না বলে নিশ্চয়তা দেওয়া হয়।
ডিমিউচুয়ালাইজেশনের ধারণাপত্র: ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই) ও চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জ (সিএসই) ডিমিউচুয়ালাইজেশন করা হচ্ছে। গত ২৯ ডিসেম্বর দুই স্টক এক্সচেঞ্জ তাদের ডিমিউচুয়ালাইজেশনের ধারণাপত্র অর্থমন্ত্রণালয়ে জমা দেয়।
উদ্যোক্তা-পরিচালকদের ৩০ শতাংশ শেয়ার সংরক্ষণ: তালিকাভুক্ত কোম্পানির উদ্যোক্তা-পরিচালকদের ৩০ শতাংশ এবং ব্যক্তিগতভাবে দুই শতাংশ শেয়ার সংরক্ষণ করতে হবে। সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (এসইসি) এ সংক্রান্ত নির্দেশনা সম্প্রতি গেজেট আকারে প্রকাশ করা হয়েছে।
প্রণোদনা প্যাকেজ: পুঁজিবাজার স্থিতিশীলতা আনতে নতুন বিনিয়োগ বৃদ্ধির মাধ্যমে বাজারকে গতিশীল করার প্রতি সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে এবং ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের স্বার্থ রক্ষায় স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদী পদক্ষেপের সমন্বয়ে বিশেষ প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেন এসইসির চেয়ারম্যান অধ্যাপক এম খায়রুল হোসন। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশের পরিপ্রেক্ষিতে এসইসির চেয়ারম্যান এই প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেন, যার ইতিবাচক প্রভাব পড়তে শুরু করেছে বলে বাজার সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা মনে করছেন।
Blogger Comment
Facebook Comment